ভূমিকা
বাংলাদেশকে জালের মতো জড়িয়ে আছে অসংখ্য নদনদী। অজানা কাল ধরে এসব নদীর স্রোতধারা বহমান। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে ছোট বড় ঝরনাধারা নদী হয়ে গ্রাম-গঞ্জ-মাঠ-প্রান্তর পেরিয়ে সাগরবক্ষে আহুতি দিচ্ছে। হাজার হাজার বছর ধরে এই জলপ্রবাহে বহমান পলি-বালিতে সাগরবক্ষে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল সমতল ভূমি। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এসব সমতল ভূমিতে সৃষ্ট মানব বসতির উত্তরাধিকার আজকের বাঙালি জনসমাজ।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত নিম্ন জলাভূমিপূর্ণ যে অঞ্চলটি অতীতে ‘ভাটিবাংলা’ হিসেবে খ্যাত ছিল, তা-ই বর্তমানে হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। আয়তনের দিকে দেশের এক-দশমাংশ পরিমাণ এ ভূ-অঞ্চলটি অসংখ্য নদনদী দ্বারা বেষ্টিত। বলা হয়ে থাকে এই নদীগুলোই হাওরের প্রাণ। এ অঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি প্রকৃতি, পরিবেশ, জনজীবন, অর্থনীতি প্রভৃতি এসব নদীর অবস্থিতি ও গতিময়তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই হাওরকে বিশদভাবে জানতে হলে এসব নদ-নদীর বিষয়েও ধারণা অর্জন প্রয়োজন।
নদনদী ও হাওরাঞ্চলের ভূতাত্বিক পরিচয়
নদনদী হচ্ছে প্রবাহমান জলধারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার্বত্য ভূমি থেকে সৃষ্ট আঁকাবাঁকা ঢালুপথে নেমে আসা জলধারা সমতল ভূমিতে এসে নদী নামে অভিহিত হয়। এর গতিপথে নানা উৎস থেকে সৃষ্ট জলধারা যুক্ত হয়ে ক্রমশ বিশালাকার ধারণ করে। নদ, নদী, উপনদী, শাখানদী প্রভৃতি নামবাচক কিছু বিভক্তির কারণে এর পরিচয়ে কখনো কখনো বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। যেমন ব্রহ্মপুত্রের ন্যায় বিশাল জলধারা নদী নয়Ñ নদ। নদ ও নদীর পৃথকত্ব ব্যাকরণগত বিশেষত্বের উপর নির্ভরশীল।
বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পুরুষবাচক নামবিশিষ্ট জলধারা ‘নদ’ নামে অভিহিত হয়। যেমন নামের শেষে ‘অ’-কারযুক্ত শব্দ হচ্ছে পুরুষবাচক আর ‘আ’, ‘ই’, ‘ঈ’ বাচক শব্দ হচ্ছে স্ত্রীবাচক। এছাড়া কোনো একটি নদী অপর আর একটি নদীতে মিলিত হলে প্রথমোক্ত নদীটিকে শেষোক্ত নদীর উপনদী বলা হয়। আবার একটি নদী হতে আরেকটি নদী সৃষ্টি হলে দ্বিতীয়টিকে মূল নদীর শাখানদী বলা হয়।
নদী, উপনদী ও শাখানদীসমূহের সমন্বয়ে সৃষ্ট নদীগোষ্ঠী (River System) যে অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় সে অঞ্চলকে সংশ্লিষ্ট নদীর অববাহিকা বলা হয়। বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল প্রধানত বরাক-সুরমা নদীগোষ্ঠীবাহিত জলধারা- যা মেঘনা নদীর প্রধান উৎস হিসেবে স্বীকৃত। তাই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটিকে ‘সুরমা অববাহিকা’ বলা হয়। সিলেট বিভাগ এবং পশ্চিমভাগের নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চল এই নদীগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত।
কেউ কেউ এটিকে ‘সিলেট অববাহিকা’ বা ‘হাওর অববাহিকা’ও বলার প্রয়াশ পেয়েছেন। এ অঞ্চলটি পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, উত্তরে মেঘালয় মালভূমির পাদদেশ, পূর্বে সিলেট বিভাগের উঁচু সমভূমি দ্বারা বেষ্টিত। প্রায় সমগ্র সিলেট বিভাগ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ এবং আংশিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নদী-উপনদীর সমন্বয়ে গঠিত এই অববাহিকা। সুপ্রাচীনকালে এই জলমগ্ন অঞ্চলটি বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত ছিল। উক্ত সুপ্রাচীন জলভাগকে লোককাহিনীর ‘কালিদহ সায়র’ বলেও অনুমান করা হয়।
হাওরাঞ্চলের ভূ–গঠনে নদীর ভূমিকা
সমতল ভূমিতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন সাধনের অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে নদী। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র এবং তাদের অগণিত উপনদী ও শাখানদী জালের মতো ছেয়ে আছে সমগ্র দেশ। এসব নদী উৎসস্থল থেকে উৎপন্ন হয়ে সাগরে পতিত হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে তিনটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূমি ক্ষয়, পরিবহণ ও সঞ্চয়ন কার্য সম্পাদন করে থাকে। হাওর অববাহিকার নদীগোষ্ঠী উক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক কালেই কালিদহ সায়র কিংবা সিলেট অঞ্চলের জলভাগকে বঙ্গোপসাগর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়কাল কতটা পেছনে ছিল?
কোবারের মহীখাত সৃজনীতত্ত্ব মতে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে বর্তমান হিমালয় পর্বতের স্থলে ছিল টেথিস সাগর। টথিস সাগরের বুকে হিমালয় পর্বতের উত্থান, বাংলাদেশ অঞ্চল আসাম সাগরে নিমজ্জিত হওয়া এবং অসংখ্য নিম্নজলা, হ্রদ ও গিরিখাত টারসিয়ারি যুগের সৃষ্টি বলে অনুমান করা হয়।
ক্রিটাসিয়াস থেকে মায়োসিন কালের মধ্যে অনুমান কয়েকবার বঙ্গখাতের উত্থান ও অবনমন ঘটেছে। এ সময়ে সিলেটের টেকেরঘাটে চুনাপাথর সৃষ্টিকারী ‘প্রবাল’ জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণির জন্ম হয়। সিলেটের বিভিন্ন স্থানে চুনাপাথর সঞ্চয় থেকে ধারণা করা হয় যে, অঞ্চলটি ওলিগো-মায়োসিন যুগে প্রায় ৩ কোটি বছর পূর্বে সমুদ্র বক্ষে নিমজ্জিত ছিল।
প্রাচীন অনেক বিদেশী গ্রন্থে সিলেটকে সাগরতীরবর্তী দেশ বলা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন বঙ্গোপসাগর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর যে বিশাল জলভাগ দৃষ্টিগোচর হয় অতীতে সেই জলাশয়েরই স্থানীয় নাম ছিল কালিদহ সায়র এবং সিলেট সে সায়রের তীরেই অবস্থিত। ‘সায়র’ থেকেই ‘হাওর’ শব্দের উৎপত্তি বলে সকলে একমত।
কালিদহ সায়র টারশিয়ারি যুগের ‘মহাগিরিজনি আন্দোলন’ কিংবা পরবর্তীতে কোনো ভূ-অবনমনের ফলে সৃষ্ট জলভাগের পরবর্তীকালীন নামান্তর হওয়াই স্বাভাবিক। অনবরত পাহাড় ক্ষয়ের মাধ্যমে নদীস্রোতে সমুদ্রবক্ষে জেগে ওঠা সমতল ভূমির মাধ্যমে প্রাচীনকালেই ইহা বঙ্গোপসাগর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকায় সঙ্কুচিত হয়ে সাগরসদৃশ নিম্নাঞ্চলে পরিণত হয়। কালক্রমে এর স্থানে স্থানে জেগে ওঠা সমতল ভূমিতে মানববসতি সম্প্রসারিত হয়। এর মধ্য দিয়ে উক্ত জলাশয়ের যে ধারা বঙ্গোপসাগরে পতিত হয় তা মেঘনা নামে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদীর মর্যাদা লাভ করে।
বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বভাগের পাহাড়াঞ্চল হিমালয় পর্বতের সাথে সংযুক্ত আসাম ও ত্রিপুরার পর্বতমালার অংশবিশেষ। এ অঞ্চলের নদীসমূহ সংশ্লিষ্ট পাহাড়াঞ্চল থেকেই উৎপন্ন। উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীগোষ্ঠী এবং উত্তরদিক থেকে সোমেশ্বরী ও কংশ নদী তাদের শতাধিক শাখা-প্রশাখার জলরাশি নিয়ে এই অববাহিকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় পতিত হয়েছে। অতিরিক্ত ক্ষয়প্রবণ এই পাহাড়শ্রেণি থেকে নদীস্রোতে বয়ে আসা পলি-বালি বিস্তীর্ণ জলভাগে সঞ্চিত হয়ে সৃষ্টি করেছে সমতল ভূমির। এভাবেই হাওর অববাহিকার ভূমি গঠনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে: “বাঙলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাঙলার ছোট-বড় অসংখ্য নদনদী। এই নদনদীগুলিই বাঙলার প্রাণ; ইহারাই বাঙলাকে গড়িয়াছে, বাঙলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনও করিতেছে। এই নদনদীগুলিই বাঙলার আশীর্বাদ; এবং প্রকৃতির তাড়নায়, মানুষের অবহেলায় কখনও কখনও বোধহয় বাঙলার অভিশাপও। এইসব নদনদী উচ্চতর ভূমি হইতে প্রচুর পলি বহন করিয়া আনিয়া বঙ্গের ব-দ্বীপের নিম্নভূমিগুলি গড়িয়াছে, এখনও সমানে গড়িতেছে; সেই হেতু বদ্বীপ-বঙ্গের ভূমি কোমল, নরম ও কমনীয়; এবং পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ব্ববঙ্গের কিয়দংশ ছাড়া বঙ্গের প্রায় সবটাই ভূতত্ত্বের দিক হইতে নবসৃষ্টভূমি। ”
পরিবেশ এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতায়ই এই নবসৃষ্টভূমির প্রথম নমূনা হাওরাঞ্চল। বঙ্গীয় ব-দ্বীপাঞ্চলে এ প্রক্রিয়া শুরুর পূর্বেই সুরমা অববাহিকায় এর প্রথম পাঠ শুরু হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের প্রাচীন গতিপথ বিশ্লেষণে মনে হয় এখানকার সেই পুরনো প্রক্রিয়ার সাথে তারও সম্পৃক্ততা ছিল। ব-দ্বীপাঞ্চল গঠনেও পদ্মা-ভাগীরথীর পাশাপাশি মেঘনার স্রোতধারা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
নদীর গতিপথ পরিবর্তন
হাওরাঞ্চলের নদীগুলোর মধ্যে সুরমা ও কুশিয়ারাই প্রধান। হাওর ও নদীর অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ অঞ্চলে হাওরবিহীন অনেক নদী আছে কিন্তু নদীবিহীন একটি হাওরও নেই। বাংলাদেশে নদীব্যবস্থার অঞ্চলভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসে ক) উত্তরবঙ্গীয় নদীমালা, খ) সুরমা-মেঘনা নদীমালা গ) গাঙ্গেয় নদীমালা ঘ) যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদীমালা ঙ) পাহাড়ী নদীমালা এই পাঁচটি বিভাগের কথা বলা হয়।
হাওরাঞ্চল সুরমা-মেঘনা নদীমালার অন্তর্গত। এই নদীব্যবস্থা বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদী এবং এদের উপনদী ও শাখানদী নিয়ে গঠিত। এরসাথে রয়েছে সোমেশ্বরী-কংশ নদীর শাখা-প্রশাখা। ভূ-গঠন ও পরিবেশ বিবর্তনে নদীর গতিময়তা ও গতিপরিবর্তন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনকাল থেকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এ অঞ্চলের নদীপ্রবাহে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গতিপরিবর্তনের কারণে কোনো কোনো নদীর যেমন বিলুপ্তি ঘটেছে তেমনি সমতল ভূমির বুকেও নতুন নদীপ্রবাহের সৃষ্টি হয়েছে।
নদনদীর গতিপথ বিষয়ক প্রাচীন ইতিহাস অস্পষ্ট। ষোড়শ ও অষ্টাদশ শতকের মধ্যে পর্তুগীজ, ডাচ ও ইংরেজ বণিক, রাজকর্মচারী ও পÐিতেরা বাংলা ও ভারতবর্ষের অনেকগুলো নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। এসব নকশায় মধ্যযুগে বাংলার নদনদী ও জনপদের যেসব পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে কোনো কোনো পুরাতন নদীর মৃত্যু, নতুন নদীর জন্ম ইত্যাদি স্পষ্ট।
১৬৬০ সালে ফানডেন ব্রোক-কৃত বাংলার ভূমি ও নদ-নদীর মানচিত্রে ব্রহ্মপুত্রকে সিলেটের পূর্বে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত দেখানো হয়েছে। ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদ মধুপুর গড়ের পূর্বদিক দিয়ে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছিল। শুধু নকশা নয়, ইবনে বতুতা, বারনি, রালফ্ ফিচ প্রমুখ বিদেশী পর্যটকের বর্ণনায়ও নদীর গতিপথ সংক্রান্ত পরিবর্তনের চেহারা দৃষ্ট হয়।
যেসব নদী হাওরাঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত তাদের মধ্যে অনেকগুলোর পরিবর্তন এ অঞ্চলের ভূমি ও পরিবেশের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। সুরমা নদীর গতিপথ একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ সদর এবং জামালগঞ্জ উপজেলার মাঝামাঝি থেকে তৎকালীন সুরমার মূলধারাটি বর্তমানের পুরাতন সুরমা এবং মরা সুরমা বরাবর প্রবাহিত হয়ে আজমেরীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হতো।
সুনামগঞ্জ সদরের ভাটিতে দক্ষিণদিকে প্রবাহিত হয়ে কালিয়াজুরিতে বাউলাইয়ের একটি ছোট প্রবাহের সাথে মিলিত হতো এবং বাউলাইয়ের মূল প্রবাহের সাথে সুরমার প্রবাহ আজমেরীগঞ্জের ভাটিতে ইটনা উপজেলায় মিলিত হতো। অন্যদিকে বরাক বা কুশিয়ারা নদী বর্তমান সোনাই-বরদাল এর গতিপথ ধরে প্রবাহিত হতো। কুশিয়ারার মূল প্রবাহ বিজনা-গুঙ্গিয়াজুরী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হবিগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহমান থাকাবস্থায় সেখান থেকে খোয়াই নদীর ধারা নিয়ে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায় বাউলাই নদীর সাথে মিলিত হতো। বর্তমানে প্রকৃতিগত পরিবেশ বির্যয়ের কারণে হবিগঞ্জ শহরের উজানে বরাকের ধারা বিলুপ্ত।
ভোগাই-কংশ নদী তখন কুঙ্গাস নামে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর প্রবাহ নিয়ে ধর্মপাশা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি বাউলাই নদীতে প্রবাহিত হতো। কুঙ্গাস (কংশ) হতে একটি শাখা ধোবাউড়া উপজেলার ভাটিতে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে তৎকালীন শিমূলকান্দির নিকট দ্বিখÐিত হয়ে একটি অংশ ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে, আরেকটি অংশ আজমেরীগঞ্জের নিকট বাউলাই নদীতে পতিত হতো।
১৮৪০ সালে প্রকাশিত তাসিনের মানচিত্রে দেখা যায়, তৎকালীন কুঙ্গাস নদী থেকে মগরা নদী উৎপন্ন হয়ে পূর্বধলা, নেত্রকোনা সদর, আটপাড়া, মদন উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফতেহপুরের নিকট ধনু নদীতে পতিত হতো। ধোবাউড়া থেকে পূর্বধলা পর্যন্ত মগরার গতিপথ বর্তমানে শুকিয়ে গেছে। ওইসব মানচিত্র থেকে বোঝা যায়, ১৮৪০ ও ১৯৪৩ সালের মাঝামাঝিতে সুরমার মূল প্রবাহ জামালগঞ্জের ভাটিতে বাউলাই নদীর সাথে মিলিত হয়। কুশিয়ারার মূল পরিবর্তন ওই সময়ই ঘটে।
পানি বিজ্ঞান বিভাগের সূত্র মতে: “বর্তমানে বিশটি সীমান্তবর্তী নদীসহ সর্বমোট ৮৭টি নদী দ্বারা এ অঞ্চলটি পরিবেষ্টিত। বর্তমানে মহারশী, চিতাখালী, দুধদা, ভোগাই, কংশ, ঘাগতিয়া, সাগরখালী, নিতাই নদীসমুহ উত্তর দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ভোগাই-কংশ নামে বাউলাই নদীতে পতিত হচ্ছে। সোমেশ্বরী নদী দূর্গাপুরের নিকট বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পথে প্রবাহিত হতো। বর্তমানে নদীটির ৩টি শাখার একটি ভোগাই নদীতে, আরেকটি উবদাখালী নদীতে এবং অন্য শাখাটি আত্রাখালী নামে উপদাখালী নদীতে পতিত হয়েছে।
এছাড়া যাদুকাটা, জালুখালী, উমিয়াম, পিয়াইন, সারী-গোয়াইন সীমান্তবর্তী নদীসমুহ উত্তরের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে সুরমা নদীর সাথে পতিত হচ্ছে। ভারত থেকে আগত বরাক নদী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের অমলসিদে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে একটি সুরমা নামে পশ্চিমদিকে এবং অপরটি কুশিয়ারা নামে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। পরবর্তীতে সুরমা জামালগঞ্জের নিকট বাউলাই নদীর সাথে মিলিত হয়ে বাউলাই নাম ধারণ করে কালিয়াজুরির নিকট ভোগাই-কংশ নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত ধারাটি ধনু নামে এই অঞ্চলের নিম্নতম ভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঘোড়াউত্রা নদীতে পতিত হয়ে বাজিতপুরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়।”
নদনদীর পরিচিতি
বাংলাদেশের মোট নদনদীর সংখ্যা ১,২১৬ টিরও অধিক; তন্মধ্যে ছোট-বড় মোট সীমান্ত নদী ১৭৩টি। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী-কমিশন কর্তৃক স্বীকৃত নদীর সংখ্যা ৫৭টি। হিমালয় ও আসাম-ত্রিপুরার পাহাড়শ্রেণি থেকে উৎপন্ন এ সকল নদীপ্রবাহ হাজার হাজার বছর ধরে পলি-বালি বহন করে সাগর বক্ষে জাগিয়ে তুলেছে যে বিশাল সমতল ভূমি। হবিগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া পর্যন্ত মেঘনা নদীর পূর্ব-তীরবর্তী অঞ্চল সুরমা-মেঘনা নদীব্যবস্থারই অন্তর্গত। প্রধানত সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা নদী এবং এদের শাখা-প্রশাখাসমূহ নিয়ে এই নদীব্যবস্থা গঠিত।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাংলাদেশের নদীসমূহকে কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত করে প্রত্যেকটির পরিচিতি নম্বর দিয়েছে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের নদ-নদী শিরোনামে প্রণীত তাদের একটি সংস্করণে ৩১০টি নদ-নদীর তথ্য প্রকাশিত হয়। এটিকে হালনাগাদ করে ২০১১ সালে আরেকটি সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। সে মতে দেশে তালিকাভুক্ত নদীর সংখ্যা ৪০৫টি। তন্মধ্যে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ১১৫টি, উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৬১টি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৮৭টি, পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে ১৬টি, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ২৪টি এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১০২টি নদী রয়েছে।
এই তালিকা ছাড়াও দেশে রয়েছে আরো বহু নদনদী। একই নদী যেমন অনেকগুলো জেলায় বিস্তৃত তেমনি এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামেও প্রবাহিত হতে দেখা যায়। এ কারণে নদীর সংখ্যা বা নাম বিষয়ে বিভ্রান্তি থাকা খুবই স্বাভাবিক। বক্ষমান নিবন্ধে সংশ্লিষ্ট পুস্তকসহ অন্যান্য মাধ্যমের ভিত্তিতে হাওরাঞ্চলের নদীসমূহকে পৃথক অবয়ব দানের চেষ্ঠা করা হয়েছে।
বিস্তারিত পর্যালোচনান্তে দেখা যায়, হাওরাঞ্চলে মোট ১০৮টি নদী রয়েছে। এই নদীসমূহকে মোট ৭টি জেলাভিত্তিক ভাগে বিভক্ত করা যায়। সে অনুযায়ী সিলেটে ২৩টি (সারণি-১), সুনামগঞ্জে ৩১টি (সারণি-২), মৌলভীবাজারে ৪টি (সারণি-৩), হবিগঞ্জে ১১টি (সারণি-৪), ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬টি (সারণি-৫), কিশোরগঞ্জে ১৬টি (সারণি-৬) এবং নেত্রকোনায় ১৭টি (সারণি-৭) নদী বিদ্যমান।
পাউবো’র তালিকাভুক্ত ৪০৫টি নদীর মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন কর্তক স্বীকৃত ৫৭টি সীমান্ত নদী রয়েছে। তন্মধ্যে হাওরাঞ্চলের সিলেটে ৭টি, সুনামগঞ্জে ৯টি, মৌলভীবাজারে ৪টি, হবিগঞ্জে ৪টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় (নাসিরনগর-সরাইল) ২টি এবং নেত্রকোনায় ৪টি অবস্থিত। সে হিসেবে দেখা যায়, সমগ্র দেশের ৫৭টি নদীর মধ্যে কেবল হাওরাঞ্চলেই সীমান্ত নদীর সংখ্যা ৩০টি।
জনজীবনে নদনদীর প্রভাব
পৃথিবীতে মানব বসতির সূচনা থেকে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করেই। জনজীবনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। ভূ-বিস্তার ঘটিয়ে নদনদী যেমন জনবসতি সৃষ্টিতে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে তেমনি এর সাথে রয়েছে জীবন প্রবাহের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের নিবিড় সম্পর্ক। মানুষের জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ, আবেগ-ভালবাসা সবকিছুর সাথেই রয়েছে নদীর সুসম্পর্ক। নদী শুধু বস্তুগত উপাদান হিসেবেই মানব ইতিহাসকে প্রভাবিত করেনি- মানুষের মন আর মননকেও করেছে ঋদ্ধ। একে কেন্দ্র করে যুগে যুগে সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী বহু সাহিত্য। জীববৈচিত্র সংরক্ষণের পাশাপাশি মানুষের বাঁচার প্রধান অবলম্বন যেসব খাদ্য উপাদান তার সবকিছুর সাথেই নদীর সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান।
এখানে প্রচুর পরিমাণ মিঠাপানির মাছ উৎপাদিত হয় যা দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের চাহিদা পূরণ করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অনন্তকাল ধরে জনবসতি স্থাপন, কৃষিকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, যোগাযোগ, পর্যটন প্রভৃতির মাধ্যমে নদী সভ্যতাকে আধুনিক কালপর্বে নিয়ে এসেছে। একই ভাবে হাওরাঞ্চলের সমাজ-সভ্যতা বিকাশের প্রতিটি ধাপে ধাপে এখানকার নদীসমূহ মূখ্য ভূমিকা পালন করে এসেছে। হাওরাঞ্চলে আজকে যে প্রাণচাঞ্চল্য আর সমৃদ্ধি, আজকে দেশের খাদ্য যোগানে যে নির্ভরযোগ্য অবদান তা-ও নদীরই অবদান।
হাওরাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পরিচিতি
হাওর অববাহিকা প্রধান ৪টি নদীরস্রোতধারায় প্রভাবিত। প্রথমটি বরাক যা এই নদীগোষ্ঠীর মূল উৎস। আন্তঃসীমান্ত এই বরাক নদী উত্তরের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা বেশ কয়েকটি স্রোতস্বিনী নদীকে ধারণ করে জকিগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরম্যা বা সুরমা নামে একটি শাখার জন্ম দিয়ে ভাটির দিকে প্রবাহিত হয়।
এরপর নদীটি পুনরায় দ্বিধা বিভক্ত হয়ে এক ভাগ কুশিয়ারা এবং অপরভাগ বরাক নামেই প্রবাহিত হয়ে স্থানে স্থানে আরো কয়েকটি শাখার জন্ম দিয়ে মেঘনার পানে ধাবিত হয়। মেঘনা হাওরাঞ্চল থেকে এই নদীগোষ্ঠীর সমস্ত জলধারা নিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। এই অববাহিকার প্রধান নদী বরাক, সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নরূপ:
বরাক নদী:
প্রাচীন শাস্ত্র মতে কথিত ‘বরবক্র‘ নদীই পরবর্তীকালে ‘বরাক’ নামে খ্যাত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ী রাজ্য মণিপুর। এর উত্তরাঞ্চলের অঙ্গামীনাগা পর্বতের ৩০০ কি.মি. উঁচু স্থান থেকে বরাকের উৎপত্তি। বরাক নদীর পার্বত্য প্রবাহের নাম কলমাং বা খলংমা। বরাক দক্ষিণ-পশ্চিমে টিপাইমুখ নামক এলাকায় এসে মিজোরামের পাহাড় থেকে উৎপন্ন তুইভাই নদীরস্রোতধারা নিয়ে সোজা উত্তরমুখে মণিপুর-মিজোরাম ও মণিপুর-কাছাড়ের সীমানা নির্ধারকরূপে ৮০.৫ কি.মি. প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম দিকে মোড় নেয়। এভাবে প্রায় ৪৯৯ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে কাছাড়ের শিলচর ও বদরপুর হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় বড় ঠাকুরিয়া ইউনিয়নের অমলসিদ নামক স্থানে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
উত্তরের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা লভা, হরি, পিয়াইন, বোগাপানি প্রভৃতি বেশ কয়েকটি স্রোতস্বিনী নদীকে ধারণ করে বরাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুই শাখায় বিভক্ত হয়েছে। এর উত্তরের শাখা সুরমা এবং দক্ষিণের শাখা কুশিয়ারা বা বরাক নামে সিলেটের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কুশিয়ারা বা বরাক ভাঙ্গার বাজার থেকে স্থানে স্থানে বিভিন্ন নাম ধারণ করে বাহাদুরপুরের নিকট পুনরায় দুই শাখায় বিভক্ত হয়।
উত্তর শাখা বিবিয়ানা নাম ধারণ করে কালনীর সাথে সংযুক্ত হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হয়। দক্ষিণ বা দ্বিতীয় শাখা বরাক নামেই নবীগঞ্জ হয়ে হবিগঞ্জ শহরের উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ধলেশ্বরীতে পতিত হতো। হবিগঞ্জ শহরের উত্তরে উমেদনগরের পূর্বপাশে এর সাথে মিলিত হতো খোয়াই নদী। সেখান থেকে বরাক ও খোয়াইয়ের মিলিত স্রোত ধলেশ্বরীতে পতিত হয়। বর্তমানে বরাক-খোয়াই সঙ্গমস্থলের উজানে বরাক অংশ বিলুপ্ত।
সুরমা নদী:
অমলসিদ থেকে বিভক্ত আন্তঃদেশীয় বরাক নদীর প্রধান শাখা সুরমা। সুরমা নদী প্রথমে পশ্চিমে ও পরে দক্ষিণ-পশ্চিমে সিলেট শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাদনার কাছে কুশিয়ারার সাথে মিলিত হয়েছে। শুরু থেকে জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, কোম্পানীগঞ্জ, দোয়ারা বাজার, ছাতক, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা প্রভৃতি উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুরমা অববাহিকার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন নামে এর বেশ কয়েকটি শাখা ও উপনদী রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান নদীসমূহের অন্যতম এটি। এর দৈর্ঘ্য ২৯৪ কি.মি. এবং গড় প্রস্থ ১১৯ মিটার।
সুরমা নদী সীমান্তরেখা ছেড়ে পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম দিকে লুভামুখ পর্যন্ত গিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। সিলেট ও গোলাপগঞ্জের মধ্যবর্তী স্থান হেতিমগঞ্জ থেকে আবার উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে সিলেট-গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক হয়ে সুনামগঞ্জে উপনীত হয়। অমলসিদ থেকে সুনামগঞ্জের দূরত্ব ২০৪ কি.মি.। সুনামগঞ্জ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ১১ কি.মি. দূরে পাইন্দা নামক স্থানে সেটা দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে দক্ষিণমুখী শাখাটি চাঁদপুর-দিরাই হয়ে মার্কুলিতে কুশিয়ারার সাথে মিলিত হয়েছে।
এটিই এককালে ছিল সুরমার মূল খাত। বর্তমানে এটি মৃতপ্রায় এবং পুরাতন সুরমা নামে অভিহিত। কিন্তু তারও পূর্বে এই শাখাটি দিরাই-চাঁদপুরের ৪ কি.মি উজানে সুজানগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে আজমিরীগঞ্জে কালনী নদীতে পতিত হয়েছে- যা মরা সুরমা নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় শাখাটি পাইন্দা থেকে নোওয়া নদী নাম ধারণ করে সুরমার মূল প্রবাহ রূপে বহমান আছে। এটি ৮ কি.মি. প্রবাহিত হয়ে উত্তর-পশ্চিমে মোড় নিয়ে ৯ কি.মি. গিয়ে আবার দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁক নেয় এবং লালপুরে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত বাউলাই নদীতে পতিত হয়। যুক্ত শাখা বাউলাই ও সুবেদপুর গ্রাম হয়ে পাগলাজুরের কাছে সুরমা (বাউলাই) নদী সিলেট জেলা ছেড়ে নেত্রকোণা জেলায় প্রবেশ করে। সেখানে কালিয়াহাট, ইটনা, মিঠামইন হয়ে ধনু ও ঘোড়াউত্রা নাম নিয়ে দিলালপুরের নিকটে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়। অমলসিদ থেকে দিলালপুরের দূরত্ব ৩৫৫ কি.মি.।
কালপরিক্রমায় নানা বিপত্তির কারণে সুগভীর সুরমা নদীর গভীরতা উজান থেকে ভাটির দিকে ক্রমশ হ্রাস পায়। নিকট অতীতেও উৎসস্থান অমলসিদ এলাকায় এর গভীরতা ছিল ১৭-১৮ মিটার; এর ৪৬.৫ কি.মি. ভাটিতে কানাইঘাটে ১৪-১৫ মিটার এবং সিলেট শহরের কাছে ১০-১২ মিটার। অমলসিদ থেকে ছাতক পর্যন্ত সুরমার দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কি.মি.। এ অংশে কয়েকটি বড় বড় বক্রখাত ছিল। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে সেগুলো কেটে সোজা করায় এর দৈর্ঘ্য হ্রাস পায়।
কুশিয়ারা নদী:
এটিও আন্তঃদেশীয় বরাক নদীর অন্যতম শাখা এবং সিলেট বিভাগের প্রধান দুই নদীর একটি। অমলসিদের নিকট বরাক নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে কুশিয়ারার একটি শাখা জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, রাজনগর, মৌলভীবাজার, নবীগঞ্জ, জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপর শাখা বাহাদুরপুরের নিকট দিয়ে নবীগঞ্জ, দিরাই, আজমিরীগঞ্জ হয়ে দিলালপুরের নিকটে মেঘনা নদী সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। আজমিরীগঞ্জ পৌরসভা থেকে কুশিয়ারা নদীর পরবর্তী অংশ স্থানীয়ভাবে মেঘনা (আপার) নামেই পরিচিত। এর ভাটি অংশে জোয়ার-ভাটার প্রভাব বিদ্যমান।
অমলসিদের নিকটে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বরাকের প্রায় ৮৫% পানিপ্রবাহ কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, রাজনগর, মৌলভীবাজার, নবীগঞ্জ, জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কুশিয়ারার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬১ কি.মি, গড় প্রস্থ ২৫০ মিটার এবং বর্ষা মৌসুমে গড় গভীরতা প্রায় ১০ মিটার। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, এ নদীতে অতীতে শুশুক, ইলিশসহ বহু প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। লঞ্চ, স্টিমারসহ বড় বড় মালবাহী জাহাজ সারা বছর এ নদীপথে চলাচল করতো।
মেঘনা নদী :
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ নদী মেঘনা হলেও এ নামে কোনো নদী উৎপন্ন হয়নি। এটি প্রধানত সুরমা-কুশিয়ারা নদীগোষ্ঠীর জলধারার সম্মিলিত স্রোত। হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে মেঘনা নামে এ নদী প্রবাহিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রাপথে ভৈরবের কাছে ব্রহ্মপুত্র এবং চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ এলাকার নদীসমূহের জলধারা মেঘনাকে দিয়েছে আরো সমৃদ্ধি।
যমুনা ও পদ্মা গোয়ালন্দের কাছে মিলিত হয়ে পদ্মা নামে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের নিকট এই মেঘনায়ই পতিত হবার পর এই সম্মিলিত প্রবাহ মেঘনা নামেই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত মেঘনার অংশ ‘মেঘনা আপার’ এবং সেখান থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত অংশ ‘মেঘনা লোয়ার’ নামে অভিহিত।
পাউবোর তালিকা অনুযায়ী সুরমা-কুশিয়ারার সঙ্গমস্থল কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম অংশ থেকে চাদপুর পর্যন্ত আপার অংশের দৈর্ঘ্য ১৫৬ কি.মি.; চাদপুর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত লোয়ার অংশের দৈর্ঘ্য ৬৫ কি.মি.। একত্রে মেঘনা নদীর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২২১ কি.মি.।
উপসংহার
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে ৭টি জেলার ৫০টি উপজেলা সমন্বয়ে ১৪,৫৩৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট হাওরাঞ্চলটি সমগ্র দেশের দশ ভাগের এক ভাগ। বিশেষ ভূতাত্তি¡ক অঞ্চল হিসেবে এর ভূগঠন, জনবসতির বিস্তার ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়াদি সংক্ষিপ্তাকারে আলোচিত হয়েছে। কৃষি বিভাগের হিসেব মতে বরাবরই প্রচুর খাদ্য-উদ্বৃত্তপূর্ণ এই এলাকাটির বৈশিষ্ট্য এবং ধরণ বাংলাদেশের যে কোনো এলাকা থেকে স্বতন্ত্র।
বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ এই হাওর অঞ্চলটি কৃষির পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদেরও বিশাল ভাণ্ডার হিসেবে স্বীকৃত। তাই এখানকার ভূমি ও জীবন-জীবিকার সাথে পরিবেশ পরিস্থিতির ঘনিষ্টতা নিবিড়। হাওরাঞ্চলের পরিবেশ প্রধানত সেখানকার পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল।
তাই প্রকৃতি নিজ দায় থেকেই সেখানকার নদীব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চলে যেমন অসংখ্য নদ-নদীর সমাহার রয়েছে তেমনি হাওরাঞ্চলেও রয়েছে এর প্রায় সমানুপাতিক নদী। নদী কেবল ভূ-ভাগে মাটির উর্বরতাই নিশ্চিত করেনা পরিবেশ, সমাজ এবং জীবন-জীবিকারও চালিকাশক্তি। এসব বিষয়ের আলোকে এখানে হাওরাঞ্চলে নদীব্যবস্থার একটি বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করা হলো।
সারণি ১
সিলেট জেলার নদী
ক্রমিক নং | নদীর নাম | পাউবো আইডি নং | মন্তব্য |
১ | আমরিখাল | NE-3 | |
২ | ইসদারখাল-বারভাঙ্গা | NE-4 | |
৩ | করিস | NE-9 | |
৪ | কাপনা | NE-11 | |
৫ | কুশিয়ারা | NE-17 | সীমান্ত নদী |
৬ | খাজাংচি | NE-19 | |
৭ | খেপা | NE-21 | |
৮ | জাফলং-ডাউকী | NE-30 | |
৯ | জালিয়াছড়া | NE-31 | |
১০ | ধলা | NE-35 | সীমান্ত নদী |
১১ | নকলা-সুন্দ্রাকাশী | NE-41 | |
১২ | নয়াগাং (খাসিয়ামারা) | NE-44 | সীমান্ত নদী |
১৩ | পাবিজুরি-কুশিগাং-কুশিয়া | NE-48 | |
১৪ | পিয়াইন | NE-49 | সীমান্ত নদী |
১৫ | পোড়াখাল-খাইয়া | NE-52 | |
১৬ | বড়গাঙ | NE-54 | |
১৭ | বেকরা | NE-60 | |
১৮ | ভাবনা-বাঁশিয়া-বহিয়া | NE-63 | |
১৯ | লাইন | NE-74 | |
২০ | লুভা | NE-76 | |
২১ | সারি গোয়াইন | NE-79 | সীমান্ত নদী |
২২ | সোনাই-বরদাল | NE-84 | সীমান্ত নদী |
২৩ | সুরমা | NE-83 | সীমান্ত নদী |
সারণি ২
সুনামগঞ্জ জেলার নদী
ক্রমিক নং | নদীর নাম | পাউবো আইডি নং | মন্তব্য |
১ | আবুয়া (নান্দিয়া গাং) | NE-2 | |
২ | উমিয়াম | NE-6 | সীমান্ত নদী |
৩ | কামারখাল | NE-12 | |
৪ | কামারখালী | NE-13 | |
৫ | কালদাহার-কানিয়াকুল | NE-14 | |
৬ | কুশিয়ারা | NE-17 | সীমান্ত নদী |
৭ | কালনী | NE-15 | |
৮ | খাসীমারা | NE-20 | সীমান্ত নদী |
৯ | গুমাই | NE-23 | |
১০ | ঘানুরা-বগালা (বুখা) | NE-25 | |
১১ | চামতি | NE-27 | |
১২ | চেলা | NE-29 | সীমান্ত নদী |
১৩ | জালুখালী (চলতি) | NE-32 | সীমান্ত নদী |
১৪ | ডাউকা | NE-34 | |
১৫ | দোলতা | NE-37 | |
১৬ | ধনু | NE-38 | |
১৭ | নলজুর | NE-43 | |
১৮ | নয়াগাং (খাসিয়ামারা) | NE-44 | সীমান্ত নদী |
১৯ | পাটনাই-পাইকারতলা | NE-47 | |
২০ | পিয়াইন | NE-50 | |
২১ | পুরাতন সুরমা | NE-51 | |
২২ | বটরখাল | NE-53 | |
২৩ | বাউলাই-বালুয়া | NE-55 | |
২৪ | বেতৈর | NE-61 | |
২৫ | ভাবনা-বাঁশিয়া-বহিয়া | NE-63 | |
২৬ | মরা সুরমা | NE-67 | |
২৭ | মহাসিং | NE-69 | |
২৮ | যাদুকাটা-রক্তি | NE-72 | সীমান্ত নদী |
২৯ | লাউরানজানি | NE-75 | |
৩০ | সোমেশ্বরী | NE-86 | সীমান্ত নদী |
৩১ | সুরমা | NE-83 | সীমান্ত নদী |
সারণি ৩
মৌলভীবাজার জেলার নদী
ক্রমিক নং | নদীর নাম | পাউবো আইডি নং | মন্তব্য |
১ | জুরী | NE-33 | সীমান্ত নদী |
২ | ধলাই | NE-35 | সীমান্ত নদী |
৩ | মনু | NE-66 | সীমান্ত নদী |
৪ | লংলা | NE-73 | সীমান্ত নদী |
সারণি ৪
হবিগঞ্জ জেলার নদী
ক্রমিক নং | নদীর নাম | পাউবো আইডি নং | মন্তব্য |
১ | করাঙ্গী | NE-18 | |
২ | কালনী | NE-15 | |
৩ | কাস্টি | SE-3 | |
৪ | খোয়াই | NE-22 | সীমান্ত নদী |
৫ | বিজনা-গুঙ্গিয়াজুরী | NE-58 | |
৬ | বিবিয়ানা | NE-59 | |
৭ | শুটকী | ||
৮ | লংলা | NE-73 | সীমান্ত নদী |
৯ | লংগন-বলভদ্র | SE-20 | |
১০ | সুতাং | NE-82 | সীমান্ত নদী |
১১ | সোনাই | SE-23 | সীমান্ত নদী |
সারণি ৫
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নদী (সরাইল ও নাসিরনগর উপজেলা)
ক্রমিক নং | নদীর নাম | পাউবো আইডি নং | মন্তব্য |
১ | কাস্টি | SE-3 | |
২ | তিতাস | SE-9 | |
৩ | মেঘনা | SE-17 | |
৪ | লাহুর | SE-19 | |
৫ | লংগন-বলভদ্র | SE-20 | |
৬ | সোনাই | SE-23 | সীমান্ত নদী |
সারণি ৬
কিশোরগঞ্জ জেলার নদী
ক্রমিক নং | নদীর নাম | পাউবো আইডি নং | মন্তব্য |
১ | ঘোড়াউত্রা | NE-26 | |
২ | নরসুন্দা | NE-42 | |
৩ | বাথাইল | NE-56 | |
৪ | সিংগুয়া | NE-81 | |
৫ | মেঘনা (আপার) | SE-17 | |
৬ | ধনু | NE-38 | |
৭ | এলংজুরি | ||
৮ | বৌলাই (বাউলাই/বালুয়া) | NE-55 | |
৯ | মগড়া | NE-65 | |
১০ | বারুনী | NE-77 | |
১১ | চিনাই (সিনাই?) | NE-80 | |
১২ | সুতি | ||
১৩ | সোয়াইজানী | ||
১৪ | কালী | ||
১৫ | ফুলেশ্বরী | ||
১৬ | কূলা নদী |
সারণি ৭
নেত্রকোনা জেলার নদী
ক্রমিক নং | নদীর নাম | পাউবো আইডি নং | মন্তব্য |
১ | উপদাখালী | NE-5 | সীমান্ত নদী |
২ | সোমেশ্বরী | NE-85 | সীমান্ত নদী |
৩ | কর্ণ-বালজা | NE-8 | |
৪ | কালাপানি ঝরা | NE-16 | সীমান্ত নদী |
৫ | গুমাই | NE-23 | |
৬ | ধলাই-বিসনাই | NE-39 | |
৭ | বালই | NE-57 | |
৮ | মগড়া | NE-65 | |
৯ | সাইদুলী-বারনি | NE-77 | |
১০ | সিনাই | NE-80 | |
১১ | পিয়াইন | NE-50 | |
১২ | ধনাখালী | ||
১৩ | কংশ | ||
১৪ | ধনু | NE-38 | |
১৫ | সুয়াই | ||
১৬ | ঢালা | ||
১৭ | নিতাই নদী | NE-46 | সীমান্ত নদী |
(বি.দ্র. মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার হাওর ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক। তার এই লেখাটি ২০ মে ২০২২ খ্রি. অনুষ্ঠিত “ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক সপ্তদশ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ২০২২” এ উপস্থাপিত। Mob: 01726342060. Email : sayedur59@yahoo.com)
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply