পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেফতারের পদক্ষেপকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এতে বড় ধরনের স্বস্তি মিলল ইমরান খানের। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে পুলিশ লাইন গেস্টহাউজে রাখার এবং সেখানে বিরোধীদের সাথে তাকে আলোচনা চালানোর পরামর্শ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আজ তাকে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে উপস্থিত হওয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দ্য ডন ও জিয়ো নিউজ।
কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে হাজির করা হয় ইমরান খানকে। তার উপস্থিতিতেই শুরু হয় তাকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) দায়ের করা আবেদনের শুনানি। প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল, বিচারপতি মুহাম্মদ আলি মাজহার এবং বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইমরানকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে দায়ের করা আবেদনের শুনানি চলাকালে তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছিল।
আদেশের এক ঘণ্টা পরে আনুমানিক বিকেল ৫:৪০টায় কর্তৃপক্ষ পিটিআই প্রধানকে তিন সদস্যের বেঞ্চের সামনে উপস্থাপন করা হয়। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল এবং খানের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথা বিনিময় হয় এবং তারপর আদেশ জারি করা হয়। পিটিআই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে সরকার উন্নয়নে অসন্তুষ্ট। ‘আপনাকে দেখে ভালো লাগছে,’ সিজেপি বান্দিয়াল খানকে যখন তাকে তিন সদস্যের বেঞ্চের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল তখন তাকে বলেন এবং তাকে গ্রেফতারের ফলে যে সহিংস বিক্ষোভ হয়েছিল তার ‘নিন্দা’ করতে বলেন।
জবাবে পিটিআই প্রধান, আদালতের কক্ষে উপস্থিত মিডিয়ার মাধ্যমে তার সমর্থকদের কাছে একটি বার্তা পাঠান যে তারা যেন সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকে। ‘আমি দেশের কোনো ক্ষতি চাই না এবং জনগণকে উসকে দিতে চাই না। আমি শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই,’ পিটিআই প্রধান আদালতকে বলেন। তিনি বলেন, তিনি জাতীয় জবাবদিহি ব্যুরোর (এনএবি) নোটিশের জবাব দেয়ার পরেও তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পাকিস্তানে কী ঘটছে তা তিনি জানেন কি না সে সম্পর্কে আদালতের প্রশ্নের জবাবে, খান বলেন যে তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং তিনি দেশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে অবগত নন। তারপর পিটিআই প্রধান তাকে বাড়িতে পাঠানোর জন্য সিজেপিকে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু শীর্ষ বিচারক বলেন যে তিনি তা করতে যাচ্ছেন না এবং তাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি ‘পুলিশ লাইন গেস্ট হাউজে শান্তিতে থাকবেন’। ‘আপনি সেখানে থাকতে পারেন, কথা বলতে পারেন, বিশ্রাম নিতে পারেন এবং তারপরে আগামীকাল ইসলামাবাদ হাইকোর্টে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন,’ খানকে বলেন সিজেপি। সিজেপি তারপরে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন খানকে তার আইনজীবী, বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যসহ সর্বোচ্চ ১০ জনের সাথে দেখা করার অনুমতি দিতে।
সিজেপি তখন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে তার বিরোধীদের সাথে সংলাপ শুরু করতে বলেন, যা সমাজে ‘শান্তি’ নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘এটি একটি ভালো পদক্ষেপ হবে যেহেতু আপনার ওপর জনগণের অধিকার অর্পিত হয়েছে। ‘প্রধান বিচারপতি বলেন, খানকে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের সাথে আলোচনা শুরু করা উচিত যদিও তিনি তাদের পছন্দ করেন না। এর আগে কমপক্ষে দু’টি মামলায় হাজিরা দিতে মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্ট চত্বরে উপস্থিত হন ইমরান খান। এ সময় তাকে নাটকীয়ভাবে গ্রেফতার করা হয়। সাথে সাথে সহিংস বিক্ষোভে জ্বলতে থাকে দেশ। ইমরান খানের গ্রেফতারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তার দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) আবেদন করে সুপ্রিম কোর্টে। সেই আবেদন শুনানির জন্য তিন সদস্যের বেঞ্চ গঠন করেন প্রধান বিচারপতি। এই বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপতি নিজে, বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ এবং বিচারপতি মুহাম্মদ আলি মাজহার। এই বেঞ্চে শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, ইমরানকে যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তা দেশের বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অসম্মানের ।
শুনানিতে ইমরান খানের আইনজীবী হামিদ খান আদালতকে জানান, অন্তর্বর্তী জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে গিয়েছিলেন ইমরান খান। সেখানে তার ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে আদালতের সংশ্লিষ্ট কক্ষে ঝড়ো গতিতে প্রবেশ করেন রেঞ্জার্সরা। তিনি বলেন, এ সময় ইমরান খানের সাথে অশোভন আচরণ করেন তারা এবং তাকে গ্রেফতার করেন। প্রধান বিচারপতি বান্দিয়াল বলেন, ‘আদালত আজ একটি উপযুক্ত আদেশ জারি করবে।’ আদালত বিষয়টি ‘অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। ইমরান খান কোন মামলায় জামিনের মেয়াদ বাড়াতে গিয়েছিলেন তা জানতে চান প্রধান বিচারপতি। বায়েমেট্রিক ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হওয়ার আগে কোনো আবেদন করা যায় কি না এ প্রশ্ন রাখেন বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ।
জবাবে আইনজীবী জানান, ইমরান খান বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন করাতে গিয়েছিলেন। কারণ এটা না করে কোনো আবেদন দাখিল করা যায় না। সাথে সাথে বিচারক আতহার মিনাল্লাহ প্রশ্ন রাখেন। বলেন, জাতীয় জবাবদিহিতা বিষয়ক ব্যুরো (এনএবি) কেন আইন নিজেদের হাতে তুলে নিলো? ইসলামাবাদ হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে এনএবি গ্রেফতারের অনুমতি চাইলে সেটাই উত্তম হতো। তিনি আরো বলেন, প্রতিজন নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সুপ্রিম কোর্টের অধিকার আছে তার বিধিবিধান নিশ্চিতের। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুশোচনা প্রকাশ করেন এই বিচারক।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আদালত চত্বর থেকে গ্রেফতারের ফলে আদালতের পবিত্রতা কোথায় গেল! তিনি আরো জানতে চান, ইমরানকে গ্রেফতার করেছেন কতজন রেঞ্জার্স। এবার জবাব দেন ইমরান খানের আরেক আইনজীবী সালমান সফদার। তিনি আদালতকে বলেন, পিটিআই চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিল ৮০ থেকে ১০০ জন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, যখন আদালত চত্বরে ৯০ জন লোক প্রবেশ করে, তখন আদালতের সম্মানের আর কী বাকি থাকে! আদালতকে অসম্মান করেছে এনএবি।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আদালতের ভেতরে এখন আর কেউই নিজেকে নিরাপদ মনে করবেন না। তিনি বলেন, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট অথবা জবাবদিহিতা বিষয়ক কোর্ট থেকে কাউকেই গ্রেফতার করা যায় না। ইমরান খানকে গ্রেফতারের মাধ্যমে আদালতের পবিত্রতাকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ পর্যায়ে বক্তব্য রাখেন বিচারক আতহার মিনাল্লাহ। তিনি বলেন, এ ধরনের গ্রেফতার আদর্শ হয়ে উঠেছে কি না এ বিষয়টি জানতে কেউ আর আদালতে আসবেন না।
একজন ব্যক্তি যখন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন, তখন তাকে গ্রেফতার করা যায় না। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল বলেন, এনএবির গ্রেফতারি পরোয়ানার আইনগত বৈধতা এবং সম্মতির বিষয় রিভিউ করবে আদালত। আদালতে আত্মসমর্পণের অধিকারকে স্যাবোটাজ করা যায় না। ইমরান খানের আইনজীবী সালমান সফদার আদালতকে অবহিত করেন যে, ‘সন্ত্রাসীদের টার্গেট লিস্টে’ নাম আছে ইমরান খানের। তার নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তাকে গ্রেফতারের সময় ঘটনাস্থলে এনএবির তদন্তকারী কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। ইমরান খানকে রেঞ্জার্সরা যেভাবে গ্রেফতার করেছেন তার কোনো উদাহরণ নেই। তখন বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ বলেন, দুর্নীতি বিরোধী এই সংস্থা (এনএবি) বছরের পর বছর বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে একই কাজ করে আসছে। এর আগে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট ইমরান খানের বিরুদ্ধে এনএবির গ্রেফতারকে বৈধ বলে ঘোষণা দেন। এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে পিটিআই। প্রাথমিকভাবে এই আবেদনের বিরুদ্ধে আপত্তি জানায় রেজিস্ট্রার অফিস। এরপর তা ফেরত পাঠানো হয় পিটিআইয়ের কাছে।
রেজিস্ট্রার অফিস বলে, যথাযথ ফোরামে উপস্থিত হননি পিটিআই চেয়ারম্যান। তিনি একটি আন্তঃকোর্ট আপিল জানাতে পারতেন। তারা আরো বলেন, যে আবেদন করা হয়েছে, তাতে পিটিআই প্রধানের স্বাক্ষর পর্যন্ত নেই। পরে বুধবার রেজিস্ট্রার অফিসের বিরোধিতার কথা তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে পিটিআই। সুপ্রিম কোর্ট তা শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।
ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ভাইস চেয়ারম্যান শাহ্ মাহমুদ কুরেশিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোররাতে কুরেশিকে গিলগিট বালতিস্তানের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জনশৃঙ্খলা রক্ষা আইনের অধীনে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গ্রেফতারের পর তাকে রাজধানী ইসলামাবাদ নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ বুধবার বিকেলেও তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়।
পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জিয়ো নিউজকে জানিয়েছেন, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় দাঙ্গা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হওয়া মামলায় পুলিশ কুরেশিকে খুঁজছিল। গ্রেফতারের আগে পিটিআইয়ের এ নেতা দেশের ‘সত্যিকারের মুক্তির জন্য’ দলীয় কর্মীদের তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি দলীয় আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ও উদ্দেশ্যের প্রতি দৃঢ় থাকার আহ্বান জানান। এর আগে বুধবার রাতে পিটিআইয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফওয়াদ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা আগে দলটির মহাসচিব আসাদ উমরকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply