১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ২৫ বয়সে সিংহাসনে আরোহনের পর কেটে গেছে সুদীর্ঘ ৭০টি বছর। এর মধ্যে ১৩ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ১৩ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। এতগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনার স্রোতের সাথে তাল মিলিয়েও অপরিবর্তিত ছিলেন একজন; তিনি রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সিংহাসনে যাকে প্রায় সাত দশক ধরে দেখেছে গোটা বিশ্ববাসী। ৯৬ বছর বয়সে আজ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিশ্বজুড়ে।
আসুন জেনে নেয়া যাক রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর কী কী হতে চলেছে সেই সম্পর্কেই। মৃত্যুর পর থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, পরবর্তী রাজার অভিষেকের মাঝের কমপক্ষে ১২ দিন পুরো ব্রিটেনে থমথমে ভাব বিরাজ করতে চলেছে। এই ঘটনার জের ধরে বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি ক্ষতি হবে ব্রিটিশ অর্থনীতির। শুধু তা-ই না, রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং তার পর পর অভিষেক- এই দু’দিনই জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হবে, যার কারণে বন্ধ থাকবে ব্যাংকের সকল লেনদেন, স্টক মার্কেট, সকল প্রতিষ্ঠান। আর তাতে গুণতে হবে বিলিয়নের উপর ক্ষতিপূরণ।
আসলে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে এই ঘটনার ভয়াবহতার মাত্রা বোঝানো সম্ভব না। রানীর চলে যাওয়া এমনই অভূতপূর্ব কিছু হতে চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যা কেউ কোনোদিন দেখেনি। ছোটখাট অনেক পরিবর্তন ইতোমধ্যেই আসা শুরু হয়েছে- বিবিসি তার সমস্ত কমেডি শো বাদ দিয়েছে, প্রিন্স চার্লস খুব সম্ভবত তার পদবী পরিবর্তন করবেন, এমনকি ব্রিটেনের জাতীয় সংগীতে কথা পর্যন্ত বদলে যেতে পেরে! শুধু তা-ই না, রানীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ ভেঙেও যেতে পারে।এর আগে প্রিন্সেস ডায়ানা এবং রানী মাতার মৃত্যুর পর পর পুরো ব্রিটেনে আছড়ে পড়েছিল শোকের ঢেউ। মানুষ হয়ে পড়েছিল হিস্টিরিয়াগ্রস্থ। কিন্তু রানী এলিজাবেথের চিরবিদায়ে পর হতে চলেছে অন্য মাত্রার কিছু।
রানীর দীর্ঘজীবিতায় মানুষ এতটাই অভ্যস্ত যে, যুক্তরাজ্যের বিশাল এক অংশ সারাজীবন ধরে রানীকে দেখে আসছে। তাই, তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরের সময়টা অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তার সময়
আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। এরপর বিশ্বখুব দ্রুত বদলে গেছে। তাই এখন কীভাবে সামলানো হবে সবকিছু, তা এখনো ধোঁয়াটে।বাকিংহাম প্যালেসের ভেতরে রানীর মৃত্যু সংক্রান্ত সাংকেতিক ভাষা ছিল ‘লন্ডন ব্রিজের পতন হয়েছে’ (London Bridge is down)। প্রাসাদের অধিকাংশ কর্মীকেই বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
সারা পৃথিবীর মানুষ ইতোমধ্যেই এই ব্যাপারে জেনে গিয়েছে সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বরাতে। বিবিসি চ্যানেল তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সমস্ত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য টিভি চ্যানেলগুলোকেও যে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই- তবে অনেকেই করবে কেউ বলে না দিলেও।
বিবিসি’র ঘোষকরা এরকম পরিস্থিতির জন্য সবসময় তৈরি হয়েই থাকেন, যাতে হঠাৎ খবর জানার পর একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে না যান! কুইন মাদার এর মৃত্যু সংবাদ দেয়ার সময় বিবিসির ঘোষক পিটার সিজনস তোপের মুখে পড়েছিলেন, কারণ সেসময় তার পরনে ছিল লাল টাই। এরপর থেকে বিবিসি’র অফিসে কালো টাই আর স্যুট সবসময় মজুদ থাকে এরকম পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য। ফলে আজও যে রানীর মৃত্যু সংবাদে কালো টাই পরিহিত সংবাদপাঠকদের দেখা যাচ্ছে, তা না বললেও চলে।শেষবার, ১৯৫২ সালে যখন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ যখন মারা যান, তখন বিবিসি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সব ধরনের কমেডি শো প্রচার বাতিল করে দিয়েছিল। এবারও রানী এলিজাবেথের বেলায়ও একই কাজ করতে চলেছে বিবিসি।
সিএনএন ইতোমধ্যেই রানীর জীবনকাহিনী নিয়ে ভিডিও তৈরি করে রেখেছে যেটা কিনা মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর দ্রুততার সাথে করা হবে। বাকি প্রধান প্রধান খবরের চ্যানেলগুলোও একইভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে যদি কর্মঘণ্টায় সংবাদটি পৌঁছায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরনের প্রটোকল মানবে সেগুলা সম্পর্কে নির্দেশনা আসবে শিল্প, গণমাধ্যম ও ক্রীড়া অধিদপ্তর থেকে। তবে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের বাইরে রানীর মৃত্যু নিয়ে সরকারের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটা এখনই আঁচ করা যাচ্ছে না।
প্রোক্লেমেশন ডে বাদে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরের দিনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে যেন এক জাতির সমস্ত শোক শুষে নিয়ে তার ভারে নুয়ে পড়েছে সেটা। গির্জার শান্ত সমাধিত ঘণ্টাগুলো বাজছে বিরতি দিয়ে দিয়ে।ব্রিটিশ রাজপরিবার সংক্রান্ত এত বড় একটা ঘটনা যে শুধু ব্রিটেনেই আলোড়ন তুলবে তা কিন্ত না। পুরো বিশ্বে প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে চলেছে একে কেন্দ্র করে। সব দেশে শীর্ষ খবর হিসেবে চলে এসেছে এটি। সারা বিশ্বের গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে সর্বশেষ অবস্থা। বিদেশে যুক্তরাজ্যের এতখানি প্রভাব শুধু কিন্তু দূতাবাসগুলোর জন্যই নয়, রাজতন্ত্রের প্রাক্তন উপনিবেশগুলো এবং কমনওয়েলথ- যারা রাজদণ্ডের প্রতি বিশ্বস্ততায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং অন্যান্য ইংরেজি ভাষা জানা দেশগুলোর জন্যও।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্র একসময় দখল করেছিল পুরো পৃথিবীর চারভাগের একভাগই। সেই উপনিবেশগুলো এখন নেই সত্য। কিন্তু মানুষের মন থেকে প্রভাব এত সহজে মুছে যায় না। কোথায় যেন সেটার ছাপ এখনো রয়ে গেছে। রানীর সেসব প্রাক্তন প্রজার মনোযোগের কেন্দ্রে আছে এই সংবাদ। উৎসব সংক্ষিপ্ত করতে পারবেন।তবে মনে হয় না চার্লস এতদিনের পুরনো ঐতিহ্যের ব্যত্যয় ঘটাবেন। সেই অভিষেক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হবে সেই একই ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে। পরিচালনাও সেই একই মানুষ করবেন- আর্চবিশপ অফ ক্যান্টেরব্যারি।পুরো অভিষেক অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে টিভিতে এবং অনলাইনে।
দেশের সব আনাচে-কানাচে, রাস্তায় রাস্তায় পার্টি দেয়া হবে, যেমনটা হয়েছিল ২০১১ সালে কেট মিডেলটন আর প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়ের পর। তাদের বিয়ের দিন যেহেতু সরকারী ছুটি ছিল, তাতে ব্রিটেনের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ১.২ বিলয়ন থেকে ৬ বিলিয়নের মতো। অভিষেক উপলক্ষেও যে এমনটাই হবে তা চোখ বন্ধ করে আন্দাজ করা যায়।আরো ছোট ছোট বিষয়…
রানী মারা যাবে, তার পুত্র নতুন রাজা হবে- ব্যাস! তাতেই কি সব ফুরিয়ে গেল? জিনিসটা কি এতই সোজা?আসলে এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে যে কতকিছুর পরিবর্তন হবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যেমন, জাতীয় সঙ্গীত। গানের কথার পরিবর্তন আসবে। রানীর বদলে গাওয়া হবে রাজার নাম। এরপর ধরা যাক, অর্থের কথা। রানীর মৃত্যুর সাথে সাথে শুরু হতে চলেছে নতুন মুদ্রা ছাপানো, যার গায়ে রানীর পরিবর্তে থাকবে নতুন রাজা চার্লসের ছবি। চার্লসের কোন ছবি বসানো হবে সেটা আগে থেকেই তোলা এবং বাছাই করা আছে।যদিও রাতারাতি এই নতুন টাকাগুলো পুরনোগুলোকে সরিয়ে দেবে না। পুরো প্রক্রিয়া শেষে হতে লেগে যেতে পারে কয়েক বছর।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply