মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অফুরন্ত রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের অমিয় বারতা নিয়ে আগমন করল মাহে রমজানুল মোবারক। আজ ১৪৪৩ হিজরি সনের পয়লা রমজান। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছেÑ হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হলো, যেমনভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের ওপরÑ এই আশায় যে, তোমরা মুত্তাকি হবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন।
আর যে কেউ অসুস্থ হয় কিংবা সফরে থাকে, তার জন্য অন্যান্য দিন থেকে এই সংখ্যা (পূরণ করা কর্তব্য)। আর যারা এতে অক্ষম হয়, তাদের কর্তব্য ফিদয়া আদায় অর্থাৎ দরিদ্রকে খাবার দেয়া। যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো কল্যাণ কাজ করবে, সেটি তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর তোমরা রোজা রাখবে, এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩-১৮৪)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার পর দ্বিতীয় বছরে এ আয়াত নাজিল হয়। এ বছর রমজানের আগমনের প্রাক্কালে সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ করে এক নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন আল্লাহর রাসূল। তাতে তিনি এই মাসের তাৎপর্য ও শিক্ষার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছিলেন। বায়হাকি শরিফে হাদিসটি সঙ্কলিত হয়েছে।
হজরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবানের শেষে একদিন আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে লোকেরা, তোমাদের মাথার ওপর এসে পড়েছে এক মহান মাস, এক কল্যাণময় মাস। এমন মাস, যাতে রয়েছে এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এক রজনি। আল্লাহ এ মাসের রোজা রাখাকে করেছেন ফরজ, আর রাতের দাঁড়ানোকে (ইবাদত) করেছেন ঐচ্ছিক। যে ব্যক্তি এতে কোনো নেককাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। আর যে ব্যক্তি এতে একটি ফরজ আদায় করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান।
যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রয়েছে পাপ মোচন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং রোজাদারের মতোই তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। কিন্তু রোজাদারের প্রতিদান কমানো হবে না। প্রশ্ন করা হলোÑ হে আল্লাহর রাসূল, রোজাদারকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের প্রত্যেকের নেই। তিনি বললেন, যে কেউ কোনো রোজাদারকে একটু দুধ, একটি খেজুর কিংবা একটু পানীয় দিয়ে ইফতার করাবে, তাকেই আল্লাহতায়ালা এ প্রতিদান দেবেন।
আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্ত করে আহার করাবে, আল্লাহতায়ালা তাকে হাউজে কাওছার থেকে পানি পান করাবেন। এ মাসের প্রথমভাগে রহমত, মধ্যভাগে মাগফিরাত ও শেষ ভাগে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এটা ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। এটা সমবেদনার মাস। এ মাসে মুমিনের রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি তার অধীনস্থের কাজের ভার লাঘব করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিন বান্দারা মহামহিম প্রভুর প্রিয় পাত্র হওয়ার সুযোগ লাভ করবে।
এ জন্য প্রথমত দোয়া করা প্রয়োজন যেন আল্লাহ তায়ালা ওই মাসের শেষ পর্যন্ত সব রোজা সঠিক নিয়মে আদায় করার তাওফিক দান করেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রজব মাস শুরু হলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে দোয়া করতেন, হে আল্লাহ আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। আল্লাহর নবীর এই বাণী ও আচরণ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি রমজানের কল্যাণ হাসিলের জন্য আগেই আল্লাহর কাছে দোয়া করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত রমজানের স্বার্থেই শরীরের যতœ নেয়া মুমিন বান্দাদের অন্যতম কর্তব্য। পুরো এক মাস দিনে পানাহার বর্জন করতে হবে। এ বছর আমাদের এই প্রতিদিনের সংযমের মেয়াদ হবে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ ঘণ্টা। লাগাতার এই সাধনায় যেন ব্যত্যয় না ঘটে, সেজন্য আল্লাহর কাছে যেমন দোয়া করতে হবে, তেমনি শরীরটাকেও প্রস্তুত রাখতে হবে। এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না, যাতে শরীরে অতিরিক্ত ক্লান্তি বা অবসাদ আসে এবং রমজানের সিয়াম পালনে বেশি কষ্ট অনুভূত হয়।
মাহে রমজানুল মোবারকের কল্যাণ লাভের একটি শর্ত হলো পাপাচার বর্জন করা। অত্যন্ত ফজিলতের মাসে রোজা পালনও প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনবে না যদি পাপাচার বর্জন না করা হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বচন ও আচরণ পরিহার করল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। অতএব রমজান শুরু হওয়ার আগেই অন্যায় ও অপরাধ পরিহারের অভ্যাস করা প্রয়োজন। রমজান শুরু হলে এ ব্যাপারে আরো যতœবান হওয়া প্রয়োজন। শাবানের শেষ দিন পর্যন্ত একভাবে জীবন পরিচালনা করে রাতারাতি বদলে যাওয়ার আশা করা অবাস্তব। পাপাচার বর্জনের সাথেই আসে তওবা ইস্তেগফারের প্রসঙ্গ। পাপরাশি থেকে মুক্ত হয়ে পূত পবিত্র অন্তরে মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ মুমিন বান্দাদের কর্তব্য।
রহমত-মাগফিরাত-নাজাতের মাসে আরেকটি বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। যে মাসটিকে বেশি থেকে অধিকতর ছওয়াব লাভের সুযোগ হিসেবে আমরা লাভ করি, সেই মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য গুদামজাত করেন অতি মুনাফার লোভে। এতে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হয়। অথচ বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা বা বিশেষ চাহিদার সময় দাম বাড়িয়ে দেয়া হারাম কাজ। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জনগণের জীবিকা সঙ্কীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে, সে বড় অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)।
রমজান মাস এলে দেখা যায়, ইফতার ও সাহ্থরির সামগ্রীসহ বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক গুণ বেড়ে যায়। অতি মুনাফালোভীরা পবিত্র রমজান মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু খাদ্যদ্রব্য অনৈতিকভাবে মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেন। রমজান শুরু হওয়ার আগে দেখা যায় চিনি, ছোলা বুট, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, মসলা, ডালÑ এ জাতীয় পণ্যগুলোর দাম আগের তুলনায় কেজিতে ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এটি মোটেই কাম্য নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের কাতারে থাকবেন।’ (তিরমিজি)।
সার্বিকভাবে রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষার লক্ষ্যে ইবাদত-বন্দেগিকে নির্বিঘœ করতে সব ব্যবসায়ীর জন্যই এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদা উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর প্রতিদান লাভের আশায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করে বরং কমিয়ে আনা এবং বাজার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি খাদ্যে ভেজাল না মেশানোই হবে সব ব্যবসায়ী ভাইয়ের নৈতিক দায়িত্ব।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply