২০২২ সালে সুইডেনের একটি মিডিয়া “নেত্র নিউজ” দীর্ঘ তদন্তের পর বাংলাদেশের গোপন বন্দীশালা “আয়না ঘর” নিয়ে একটি সংবাদ প্রচার করে। আয়নাঘর মানে আপনি আপনার নিজের চেহারা নিজে দেখবেন, অন্য কেউ আপনাকে দেখতে পারবে না, দেখতে দেয়া হবে না। সারা বিশ্বে তা নিয়ে হইচই শুরু হলেও বাংলাদেশ সরকারের ডিজিএফআই, র্যাব ওই নিউজের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
অভিযোগ রয়েছে-শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ২০০৯ সালে এসব বন্দীশালা গড়ে তুলেন শেখ হাসিনা। সরকারের বিরোধীতাকারীদেরকে আইন শৃংখলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায় কিন্তু আদালতে সোপর্দ করেনি, বিচারের মুখোমুখি করেনি, আত্বীয় স্বজনকে জানতেও দেয়নি আসলে সে মারা গেছে না কি জীবিত আছে। তাদেরকে মাটির নিচে বিশেষভাবে তৈরী বন্দীশালা আয়নাঘরে নিয়ে নৃশংস নির্যাতন করা হতো। ভিন্নমত পোষন করায় ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর মেজর হাসিনুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয় এবং তাকে আটক করা হয়।
ঢাকার মিরপুরের বাসা থেকে হাসিনুর রহমানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় আরও ১৪/১৫জনকে তুলে নিয়ে যায় আইন শৃংখলা বাহিনী। ১৬ মাস আয়নাঘরে রেখে নির্যাতনের পর তাকে ছাড়া হয়। আন্তর্জাতি মানবাধিকার কর্মী মিশেল ব্যাশেলেট বাংলাদেশ সফরের সময় আইন শৃংখলা বাহিনীর গোপন বন্দী শালায় শতশত লোককে আটকে রাখার বিষয়ে তথ্য তুলে ধরে প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায় বিচার নিশ্চিতের দাবী জানান। নেত্র নিউজের সংবাদ, মিশেল ব্যাশেলেটের তথ্য, মীনাক্ষি গঙ্গোপাধ্যায়ের গোপন বন্দীশালায় শতশত মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতনের দাবী এসবকে সামনে রেখে নিখোজ শতশত ব্যক্তির স্বজনরা তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে গড়ে তুলেন “ মায়ের ডাক” নামে একটি সংগঠন।
গোপন বন্দীশালা থেকে ছাড়া পাওয়া সালিম নামের এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে নেত্র নিউজ। সালিম জানান- বন্দীশালা আয়নাঘরের কক্ষগুলোতে কোনো জানালা নেই, অনেক উচুতে একটি ছোট বাল্ব থেকে সামান্য আলো পাওয়া যেত, কোথাও বিশালাকার এডজস্ট ফ্যান সারাদিন চলত, যার শব্দে বাহিরের কোনো শব্দই নির্জন কক্ষে পৌছত না, কোনো কোনো সময় আশপাশের কক্ষগুলো থেকে মানুষের ক্ষীণ আর্তচিৎকার শুনা যেত। মাঝে মাঝে কম্পন অনুভব হতো, সালিমের ধারনা কাছাকাছি কোথাও বিমান বন্দর বা বিমানঘাটি রয়েছে। সালিম জানিয়েছেন- ঠিক কতজন লোককে সেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে তা ধারনার বাহিরে। এক পর্যায়ে সালিমকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান।
২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে নিখোজ মাইকেল চাকমা। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের ইউপিডিএফ এর নেতা। মাইকেল চাকমাকে আয়নাঘরের বন্দীশালায় রাখা হয়। গত ৭ আাগষ্ট তিনি ছাড়া পান। নেত্র নিউজ সামরিক এক অফিসারের নাম প্রকাশ না করে তার উদ্বৃতি দিয়ে লিখে- একটি আয়নাঘরে ৩০টির মতো ছোট ছোট কক্ষ আছে। নেত্র নিউজ লিখে অন্তত ২৩টি আয়না ঘর আছে শুধু ঢাকাতেই। আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া সালিম ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আয়না ঘরের নির্মম নির্যাতন ও বর্বরতার কথা তুলে ধরেন। দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পরপরই অন্তত ৩জন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন বন্দীশালা আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান। তাদের একজন ব্যারিষ্টার আরমান।
৮ বছর আগে তাকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আইন শৃংখলা বাহিনী। তারপর তার আর কোনো খোজ ছিল না। ব্যারিষ্টার আরমান লিখেছেন- তাকে বন্দীশালায় বর্বর নির্যাতন করা হতো, যেহেতু তাকে খাবারই দেয়া হতো অত্যন্ত কম, তাই তিনি রোজা রাখতে চাইতেন। তাকে রোজা রাখতে দেয়া হতো না, খাবার দেয়া হতো না, পচাবাসী দুর্গন্ধযুক্ত স্বল্প পরিমান খাবার দেয়া হতো। তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ৭৫ কেজি ওজনের আরমানের বর্তমান ওজন প্রায় ৪০/৪২ কেজি।
সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীও গোপন বন্দীশালা থেকে ফিরেন ৬ আগষ্ট। ৮ বছর আগে তাকেও তার বড় বগবাজারের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আইন শৃংখলা বাহিনী। তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন- বন্দীশালায় নির্যাতনের কারণে গামছায় যে পরিমান চোখের পানি তিনি মুছেছেন তা সংরক্ষন করলে একটি দিঘীতে যে পরিমান পানি থাকে তার সমপরিমান পানি হতো। সুইডেনের নেত্র নিউজ, ভারতের আনন্দবাজারসহ দেশ বিদেশের অনেক মিডিয়া জানিয়েছে- শেখ হাসিনা শুধু নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ২০০৯ সাল এবং পরবর্তী কয়েক বছরে ভিন্ন মতের রাজনৈতিক নেতা, তার সরকারের বিরোধীতাকারী অন্তত ৬০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে গোপন বন্দীশালা আয়নাঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোককে বিভিন্ন সময়ে ফেরত দেয়া হয়েছে।
বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলীসহ বেশিরভাগেরই এখনো কোনো খোজ নেই। তারা মৃত না জীবিত তা কেউ জানে না। মাসের পর মাস একটি ছোট্ট কক্ষে সামান্য শ্বাস নেয়ার মতো বাতাস পাওয়া ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ ছিলনা বন্দীদের। অনেকে এ অবস্থায় মৃত্যুবরণও করেছেন বলে ধারনা করা হয়েছে। নিখোজদের স্বজনদের দাবীর প্রেক্ষিতে ৭ আগষ্ট ডিজিএফআই জানিয়েছে তাদের বন্দীশালায় আর কোনো লোক নেই। প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন বছর গোপন বন্দীশালায় আটকে থাকার পর ছাড়া পাওয়া এক কিশোরের আপন চাচা এ প্রতিবেদককে জানান-“তার ভাতিজা মুক্ত হওয়ার পর আধা পাগল হয়ে গেছে।
তার কথায় অসংলগ্নতা রয়েছে। বন্দী শালা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে আতংকে এড়িয়ে যায়। আবারো বন্দীশালায় নিয়ে যাওয়ার আতংক তার মধ্যে বিরাজ করছে”। অনেক অনুরোধের পর বন্দীশালা থেকে ফিরে আসা কিশোরের চাচা জানান- “ তার ভাতিজা তাকে বলেছে- অনেক সময় মনে হতো তাকে সমতল থেকে অনেক নিচে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানে তাকে মাসের পর মাস রাখা হয়েছে, আবার তাকে সমতলে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে, এভাবেই তার দিনগুলো কেটেছে। একই বৈদ্যুতিক আলোতে তাকে মাসের পর মাস কাটাতে হয়েছে, সূর্যের আলো কতদিন বা কত মাস পর পর সে দেখেছে কোনো হিসাব নেই তার কাছে।
১৪/১৫ বছরের ওই শিশু/কিশোরকে জেএমবির সদস্য আখ্যা দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে সাড়ে তিন বছরেও কোনো অভিযোগ দাড় করাতে না পারায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বর্তমানে ওই কিশোর (বর্তমানে যুবক) বৃহত্তর সিলেটের একটি জেলায় একটি হাই স্কুলের অফিস সহকারী হিসাবে কর্মরত। বছরে এক দুইবার গোপনে বাড়িতে এসে তার দাদীকে দেখে যায়।। নিরাপত্তার কারণে ওই কিশোর বা তার চাচার নাম প্রকাশ করা হল না। শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এমন নৃশংসতা বিশ্বের কোনো দেশে আছে? আমেরিকার বন্দীশালা গোয়ান্তেনামো বে কারাগারে কারা ছিল তা অন্তত জানা যেত, জার্মানীল নাৎসী বাহিনীর হাতে কারা নির্যাতিত হতো তা জানা যেত, কিন্তু শেখ হাসিনার বন্দীশালা আয়নাঘরে কারা আছে, কারা নির্যাতিত হচ্ছে তা জানার কোনো সুযোগ ছিল না। আয়নাঘর ভেঙ্গে দেয়ার এখনই সময়।
এম এ মজিদ
আইনজীবী ও সংবাদকর্মী
হবিগঞ্জ ।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply