মূলধন সঙ্কট দেখা দিয়েছে দেশের ১৫টি ব্যাংকের। ব্যাংকগুলো ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। এক দিকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, অপর দিকে মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকির মাত্রাও বেড়ে গেছে। গত জুন শেষে আলোচ্য ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা বা প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাতটি সরকারি, ছয়টি বেসরকারি ও দু’টি বিদেশী ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে নতুন প্রজন্মের দু’টি ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংক দু’টি হলো বেঙ্গল ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ায় ও খেলাপি ঋণের আধিক্যের কারণে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে গেছে। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে কাক্সিক্ষত হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি আলোচ্য ১৫টি ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। আর এর কম হলেই মূলধন ঘাটতি দেখা দেবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ মূলধন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকিং খাতের রেটিং খারাপ হবে। এতে পণ্য আমদানিতে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। ফলে থার্ডপার্টি গ্যারান্টির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করতে হবে। এতে ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাবে।
আবার সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বছরের পর বছর কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকতে পারবে না। আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত মেনে নেবে। দুই বছরের পর মূলধন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংককে হয় মার্জার অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে যেতে হবে, অথবা বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হলে, তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কিভাবে মূলধন ঘাটতি পূরণ করবে তার পরিকল্পনা জমা দিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে তা মনিটরিং করবে। এভাবে দুই বছর পর আইন অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দেখা দিলেও এর বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ গত জুনভিত্তিক পরিসংখ্যান মতে, মূলধন ঘাটতিতে থাকা ১৫ ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকেই মূলধন ঘাটতি ১০ হাজার কোটি টাকার উপরে। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ন্যূনতম সাত হাজার ৭১৮ কোটি টাকার মূলধন সংরক্ষণ করার কথা ছিল; কিন্তু ব্যাংকটি আলোচ্য সময়ে মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে তিন হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। জুন শেষে ঘাটতি রয়েছে তিন হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। তেমনিভাবে বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে দুই হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। ব্যাংকটি জুন শেষে ন্যূনতম এক হাজার ৮৮৪ কোটি টাকার মূলধনের মধ্যে এক টাকাও সংরক্ষণ করতে পারেনি; বরং আগে থেকেই ঘাটতি ছিল ৪৬৭ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের ৮৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করার কথা ছিল আট হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা; কিন্তু ব্যাংকটি মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে ছয় হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। ঘাটতি রয়েছে দুই হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।
অনুরূপভাবে আলোচ্য সময়ে রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে দুই হাজার ২৩০ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকা।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে নতুন প্রজন্মের বাণিজ্যিক ব্যাংক বেঙ্গল ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে ৮৮ কোটি টাকা এবং সিটিজেন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে ৯৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া সমস্যাকবলিত কমার্স ব্যাংকের এক হাজার ৩১৩ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৮১২ কোটি টাকা এবং সাবেক ফার্মার্স বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি টাকা এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের এক হাজার ৩৭৯ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি হয়েছে জুন শেষে। এ ছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে দুই হাজার ৩৮৫ কোটি টাকার।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply