প্রায় দুইশ বছর আগে এরাবিয়ান এক ব্যবসায়ীর প্রথম নজরে আসে সাগরে ভেসে থাকা এক দ্বীপ। নিজ থেকেই তিনি এর নাম দেন আইসল্যান্ড জাজিরা। তখন বৃটিশরা এদেশ শাসনে ছিল। চট্টগ্রামের ডিপুটি কমিশনার মিস্টার মারটিনও সাগরের মধ্যখানে জেগে উঠা দ্বীপে একাধিকবার যান। তিনি তার নামটি আইসল্যান্ড জাজিরায় বসিয়ে দেন।
এরাবিয়ান এক যাজক বা সেইন্টও দ্বীপ নিয়ে কিছু কাজ করেন। ওই যাজকের নাম কেউ জানে না, তবে যাজক বা সেইন্ট হিসাবে সবাই তাকে জানতো। সেইন্ট নামটি সর্বাগ্রে জুড়ে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে হয়ে যায় সাগরে ভেসে থাকা দ্বীপের নাম সেইন্ট মার্টিন আইসল্যান্ড জাজিরা। স্থানীয়দের কাছে এ দ্বীপটির নাম নারিকেল জিনজিরা, কুরাল দ্বীপ, দারুচিনির দ্বীপ। বাংলাদেশের এক বিশাল সম্পদ।
পর্যটকদের কাছে স্বপ্নের দ্বীপ। শতশত ফুট গভীর সাগরের মধ্যখানে পাথর ও বালির সংমিশ্রনে জেগে উঠা দ্বীপের উদ্দেশ্যে দেরীতে হলেও আমরা তিন বন্ধু আমি এম এ মজিদ, আমেরিকা প্রবাসী শামসুল ইসলাম ও সৌদী আরব প্রবাসী আবদাল আহমেদ ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ রাত ৯টার দিকে নিজ নিজ বাসা থেকে বের হই।
শায়েস্তাগঞ্জ রেল স্টেশনে গিয়ে দেখি ৫দিন আগে উদয়ন ট্রেনের অনলাইনে কাটা আমাদের টিকিট গুলো কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। আমার অপরাধ! ছিল একজন রেল অফিসারের মাধ্যমে কাটা টিকিটগুলো কেন আমি দ্রুত সময়ের মধ্যে স্টেশন থেকে উত্তোলন করলাম না। যার মাধ্যমে টিকিগুলো নিয়েছিলাম বেশি দামে সেই ভদ্র লোকের সহজ প্রস্তাব “ পরের দিন যান, ভাল হবে” কে তাকে বুঝাবে একটি চেইন প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে আমরা বের হয়েছি। হবিগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার, হোটেল, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ, টেকনাফ থেকে জাহাজে করে সেইন্টমার্টিন, আবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরা, ফেরার পথেও অনুরুপ চেইন মেকিং করা।
চেইনের একটি ঘাট ছিড়ে গেলে সবগুলোতেই আঘাত করবে। ভ্রমনে বিপত্তি ঘটতেই পারে, আপনি যে পরিকল্পনা করে বের হয়েছেন, সে পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে, এসব বিপত্তি আমার মুখস্ত। কাজেই ঘাবড়ে গেলাম না। ওয়াটসএ্যাপে থাকা ১০৬৫ টাকার ৩টি টিকিটের কপি (আমি কিনেছি ১৪০৫টাকা দিয়ে) আমার কাছে মূল্যহীন, আবার আমাকে কিনতে হল ৩টি স্ট্যান্ডিং টিকিট।
পরে জানতে পারলাম আমার কাছে ১৪০৫ টাকায় বিক্রি করা টিকিটগুলো সোনালী ব্যাংকের অফিসার চাদপুরের সুমন দাস কিনেছেন ১৮শ টাকা দিয়ে। আমাদের এই অবস্থা দেখে ভদ্র লোকের মন খারাপ, তিনি তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে বড় লোক হতে আর কি লাগে? একজন টিকিট কালোবাজারীই যথেষ্ট। দাড়িয়ে দাড়িয়ে রাত সাড়ে ৩টা দিকে কুমিল্লা পৌছে সিটে বসতে যাব এমন সময় বন্ধু শাহেদের ফোন।
তারা পরিবার নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছে, কেবিন আছে। আমরা যেন তাদের কেবিনে চলে যাই। সিটে বসলে হয়তো কিছুটা ঘুমাতে পারতাম, চলে গেলাম কেবিনে, আড্ডায় আড্ডায় প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম। সকাল ৮টার দিকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম থেকে বাসে রওয়ানা হয়ে ১৫২ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সময় লাগল সাড়ে ৩ ঘন্টা। ১টার দিকে হোটেল সি প্রিন্সেসে উঠেই দ্রুত সময়ের মধ্যে বের হলাম, কারণ আগের দিন রাত ৮টার দিকে খাওয়ার পর কার্যত কিছুই আমাদের খাওয়া হয়নি।
আমার সাথে নেয়া রুটি ও ডিম খেতে দিয়েছি শাহেদ ও আব্দুল আওয়াল বাবুলের বাচ্চাদেরকে। সাগরের পাশের একটি হোটেলে খেতে বসে মনে হলো চিংড়ি মাছের ভর্তাটি পুরোপুরি বালি দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। একই ভাবে অন্য সবজি ও তরকারীতেও বালির আধিক্য ছিল। অনেকটা না খেয়ে উঠে গেলাম। ঘুম নেই খাবার নেই তবুও আমাদেরকে সাগর খুব টানছে। ২টার দিকে বঙ্গোপসাগরে নেমে পুরো দুই ঘন্টা পর সাগর থেকে উঠলাম আমি ও শামসুল। হোটেলে এসে মনে হল একটু ঘুমানো দরকার।
কিন্তু মন ছুটে যায় সাগরপানে গর্জন শুনতে, সাগর কন্যা কক্সবাজারকে দেখতে। অবিচ্ছিন্নভাবে ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য কোনো সৈকত বা বিচ বিশ্বের কোথাও নেই। যা কক্সবাজারে রয়েছে। যদিও ব্রাজিলের কাসিনো বিচ এর দৈর্ঘ্য ২১২ কিলোমিটার। তবে সেটি বিচ্ছিন্নভাবে, অস্ট্রেলিয়ার ১৫১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বিচও বিচ্ছিন্ন সী বিচ। কক্সবাজারের পূর্ব নাম ছিল প্যানোয়া, পরে পালংকি।
বৃটিশ ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর নাম থেকে বর্তমানে এর নাম কক্সবাজার। সন্ধার দিকে বের হয়ে অজানা অচেনা এক বন্ধু রেজাউলের সাথে দেখা করলাম। রেজাউল আমাদের সাথে শুধু এসএসসি পাশ করেছে। আমাদের এসএসসি পাশের একটি গ্রুপ রয়েছে। সেই থেকে অনলাইনে একবার তার সাথে কথা হয়েছে। সাজানো গোছানো তার অফিস দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। তার পাস্তা খাওয়ানো ছিল চমৎকার।
রেজাউলের মাধ্যমেই আমরা পরের দিন ভোর ৬টার বাসের টিকিট কাটলাম টেকনাফের। টেকনাফ থেকে বারো আওলিয়া জাহাজের রিটার্ন টিকিট, আমাদের গন্তব্য সেইন্টমার্টিন আইসল্যান্ড। আমাদেরকে জানানো হল বিকাল ৩টার দিকে জাহাজ ফিরবে, সেই জাহাজে এসে টেকনাফ-ঢাকার বাস সেইন্টমার্টিন সি ভিউয়ে করে চট্টগ্রাম ফিরতে হবে। নাফ নদি হয়ে যখন আমাদের জাহাজাটি ৩ হাজারের বেশি যাত্রী নিয়ে বঙ্গোপসাগরে নামতে যাবে তখন একটা ধাক্কা খেলাম। জাহাজ আটকে গেছে চড়ে।
নাবিকের কৌশলে সেই যাত্রা সফল। মাইকে ঘোষনা হল আমাদের জাহাজটি বিকাল ৩টায় নয় ৫টায় সেন্টমার্টিন ত্যাগ করবে। কারন সাগরে জোয়ার নেই। আবারও আটকে যেতে পারে জাহাজ। ভাবলাম, দুই ঘন্টা সময় বেশি পাওয়ায় ভালই হল। ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ও আধা কিলোমিটার প্রস্থের দ্বীপটি ঘুরে দেখতে পারব। ৭হাজার ৩শ স্থানীয় মানুষের বসবাসের সেইন্টমার্টিনে ভোটার সংখ্যা ১৫শ। সেইন্টমার্টিন একটি ইউনিয়ন। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে এ দ্বীপটি প্রায় ৪ মিটার উচু। সেইন্টমার্টিনকে সাগরের আকষ্মিক বড় বড় ঢেউ থেকে রক্ষা করতে ১০/১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রবাল প্রাচীর রয়েছে।
যা প্রাকৃতিকভাবে তৈরী। সাগরের ঢেউ পাথরে এসে আছড়ে পড়বে, মাটি বা বালিতে নয়। সেইন্টমার্টিনকে ৩টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। উত্তরপাড়কে বলা হয় নারিকেল জিনজিরা (যদিও শতশত নারিকেল গাছের একটি গাছেও আমরা নারিকেল দেখিনি, একেকটি ছোট আকারের নারিকেলের দাম সেখানে ১শ থেকে দেড়শ টাকা), দক্ষিন পাড়া ও গলাচিপা। মূল সেইন্টমার্টিন থেকে একটু দুরে রয়েছে ৫০০ মিটার আয়তনের জনমানব শূন্য একটি দ্বীপ, যার নাম ছেড়া দ্বীপ। জোয়ারের সময় নৌকা দিয়ে যেতে হয়, ভাটার সময় পায়ে হেটেই যাওয়া যায়। সেইন্টমার্টিনে কোনো বহুতল ভবন নেই, সম্প্রতি এক ছাদ দেয়া কয়েকটি ভবন তৈরী করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মসজিদ, ইউনিয়ন অফিস, বেতার কেন্দ্র রয়েছে।
সেইন্ট মার্টিনের ৭০ ভাগ ঘর কুড়ে ঘরের মতো। হুমায়ুন আহমেদের সমুদ্র বিলাশে ৪টি কটেজ রয়েছে, তাও টিন ছন বাশের তৈরী, প্রথমে দেখলে আপনাকে পরিত্যক্ত মনে হবে। এগুলো প্রতি রাতের জন্য ৪ হাজার টাকায় ভাড়া দেয়া হয়। সেইন্টমার্টিনের কটেজ মানে অনেকটা কুড়েঘর। আপনি পায়ে হেটে পুরো সেইন্টমার্টিন ঘুরে বেড়াতে পারবেন। সেখানে খাবারের দাম বেশি, মান ভাল না। বিকাল ৫টায় আমাদের জাহাজ ছাড়ল টেকনাফের উদ্দেশ্যে।
৯ কিলোমিটার সাগড়, নাফ নদি, মায়ানমার মোহনা পাড়ি দিতে জাহাজের সময় লাগল সাড়ে ৩ ঘন্টা। রাত ৯টায় এসে দেখি যে বাসের আমাদের টিকিট কাটা সেই বাস আমাদেরকে সাগরে রেখেই চলে গেছে চট্টগ্রাম-ঢাকার উদ্দেশ্যে। টেকনাফ থেকে রাত ৯টার পর কোনো বাস চলে না, সেখানে থাকার মতো কোনো হোটেলও নেই।
মেরিন ড্রাইভ দিয়ে সিএনজিতে কক্সবাজার আসা ঝুকিপর্ণ। ছিনতাইকারীর ভয় রয়েছে। কেন আমাদেরকে রেখেই বাস চলে গেছে অভিযোগ দিয়ে আমরা টেকনাফ থেকে সর্বশেষ বাসে করে রাত ১টার দিকে কক্সবাজার এসে পৌছুলাম। আমাদেরকে সেইন্টমার্টিন সি ভিউ বাস কর্তৃপক্ষ আশ্বস্থ করল যত রাতেই আমরা কক্সবাজার পৌছি না কেন আমাদেরকে তারা নিজেদের বাসে করে চট্টগ্রামে পৌছে দেবে। ডলফিন মোড় থেকে আমাদের পরবর্তী যাত্রা চট্টগ্রাম । রাত তখন ৪টা, আমরা চট্টগ্রামে।
সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন। রেল স্টেশনের বাহিরে খোলা আকাশের নীচে আমাদের কাটল রাতের শেষ সময়। দুপুর ২টার দিকে যখন বাসায় ফিরলাম তখন মনে হলো ৩ দিনে প্রায় ১২শ কিলোমিটার জার্নির মধ্যে আমাদের ঘুম হয়েছে মাত্র ৫ ঘন্টা। এবার একটা দীর্ঘ ঘুম যে প্রয়োজন।
লেখকঃ এম এ মজিদ, আইনজীবী ও সংবাদকর্মী
হবিগঞ্জ ২৫/২/২০২৩ ইং
০১৭১১-৭৮২২৩২
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply