পাহাড়সম সাফল্যের তিন বছরও হয়নি, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে ১৯৮৭ সালের পর কনজারভেটিভদের সবচেয়ে বড় বিজয় এনে দিয়েছিলেন টোরী নেতা বরিস জনসন।
সেই নেতা প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকেই নিজের দলের পার্লামেন্ট সদস্যদের সমর্থন হারিয়ে মর্মান্তিক ভাবে বিদায় নিতে হল। গতকাল ৭জুলাই বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস ডাউনিং স্ট্রিটে সংবাদ সম্মেলনে এসে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, “আমি জানি, অনেকে আছেন, যারা স্বস্তি পেয়েছেন, কেউ কেউ হয়ত আছেন, যারা হতাশ হয়েছেন। আমি আপনাদের বলতে চাই, বিশ্বের সেরা কাজটা ছেড়ে দিতে আমার কতটা দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য!
কেন এবং কিভাবে এই পরিণতিতে পৌঁছালেন জনসন? বিষয়টি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। গেল ২৯ জুন পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ পার্টির তৎকালীন ডেপুটি চিফ হুইপ ক্রিস পিনচার লন্ডনের একটি ‘সংরক্ষিত’ নাইট ক্লাবে যান এবং তার ভাষায়, সেদিন তিনি সেখানে ‘অনেক বেশি মদ পান করেছিলেন’ এবং সে কারণে ‘নিজেকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিলেন’।কী করেছিলেন পিনচার? সেখানে দুইজন পুরুষকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।
এর জের ধরে তার বিরুদ্ধে কয়েক বছরের পুরোনো একগাদা যৌন অসদাচরণের অভিযোগও বেরিয়ে আসে।তাতে নতুন করে চাপে পড়েন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, যাকে আরও অনেক কেলেঙ্কারি সামলে টিকে থাকতে হচ্ছিল। বরিস জনসন পিনচারের বিষয়গুলো জানার পরও তাকে কনজারভেটিভ পার্টির ডেপুটি চিফ হুইপ করেছিলেন, আর এ কারণে নিজে দলের এমপি ও মন্ত্রিসভার সদস্যরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রকাশ্যে। প্রথমে ডাউনিং স্ট্রিটের পক্ষ থেকে ওই অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানায়, ফেব্রুয়ারিতে যখন এমপি পিনচারকে ডেপুটি চিফ হুইপ করা হয়েছিল, তখন তার বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’গুলোর বিষয়ে জানতেন না বরিস জনসন। বিবিসি তাদের বিশ্লেষনে বলেছে, এরপরেও প্রধানমন্ত্রী ওই অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন যদিও এটা কয়েকবার প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি পিনচারের অতীত কর্মকান্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন।গেল ৪ জুলাই সংবাদ মাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী জনসন পিনচারের বিরুদ্ধে তোলা অন্তত একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিষয়ে জানতেন।
পরদিনই সাবেক সরকারি কর্মকর্তা লর্ড ম্যাকডনাল্ড জানান, তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে পিনচারের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। ম্যাকডনাল্ডের বক্তব্য গণমাধমে প্রচার হওয়ার পর বরিস জনসন স্বীকার করেন, ২০১৯ সালে পিনচারের বিষয়ে তাকে জানানো হয়েছিল। সব জেনেও পিনচারকে ডেপুটি চিফ হুইপের দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর পার্টি কেলেঙ্কারিঃ এর আগে এ বছরের এপ্রিলেই প্রধানমন্ত্রীকে জরিমানা গুণতে হয়েছে, ২০২০ সালে সমগ্র ব্রিটেনজুড়ে কড়া লকডাউনের বিধিনিষেধ কার্যকর থাকা অবস্থায় জন্মদিনের উৎসব আয়োজন করে নিয়ম ভঙ করার কারণে। ব্রিটেনের ইতিহাসে বরিস জনসই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যাকে পদে থাকা অবস্থায় আইনভঙ্গের জন্য দোষী সাব্যস্থ হয়ে জরিমানা দিতে হয়েছে।
২০২০ সালেই কোভিড-১৯ মহামারী ঠেকাতে প্রথমবার আরোপিত লকডাউনের সময় ডাউনিং স্ট্রিটের বাগানে মদের পার্টি করে কেলেঙ্কারির জন্ম দেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। পরের বছর গণমাধ্যমে ওই খবর প্রকাশ হওয়ার পর এ নিয়ে তিনি জাতির কাছে ক্ষমাও চান।লকডাউনের বিধি ভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে ডিসেম্বরে হাউজ অব কমনসে তিনি দাবি করেছিলেন, “১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে সব ধরনের নির্দেশনা পুরোপুরিভাবে মেনে চলা হয়েছে।” বিষয়টি নিয়ে এখন তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে একটি কমনস-কমিটি। এই কমিটি জানার চেষ্টা করছে, প্রধানমন্ত্রী জেনেশুনে পার্লামেন্টকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা।
মূল্যস্ফীতিঃ জনগণের ওপর করের বোঝা বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অনেক দেশের মত ইউনাইটেড কিংডমেও চলতি বছর মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে বেড়েছে, অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ সূচক উঠেছে ৯ দশমিক ১ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার অনেকগুলো কারণই ছিল জনসনের সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কথা বলা যায়। ওই যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় অবরোধ আরোপ করায় জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে।ব্রিটিশ সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় জ্বালানি তেলের ওপর থেকে শুল্ক কমানোসহ কিছু পদক্ষেপ নিলেও এপ্রিলে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়, কর বাড়ানোর ফলে স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা খাতে ব্যয় নিশ্চিত করা যাবে।
নতুন কর হারে ব্রিটেনে ৩৪ হাজার পাউন্ডের বেশি আয়ের জন্য আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হচ্ছে।পার্লামেন্টের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা স্যার কির স্টারমার এপ্রিলে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছিলেন, সরকার শ্রমজীবীদের ওপর কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ওয়েন প্যাটারসন বিতর্কঃ ২০২১ সালের অক্টোবরে হাউজ অব কমনস কমিটি তৎকালীন কনজারভেটিভ এমপি ওয়েন প্যাটারসনকে ৩০ দিনের জন্য বহিষ্কারের সুপারিশ করে।
কমিটি জানায়, ওয়েন প্যাটারসন লবি বা তদবির করতে গিয়ে বিধি ভঙ্গ করেছেন। তিনি কয়েকটি কোম্পানিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, বিনিময়ে তিনি কোম্পেনীগুলোর কাছ থেকে অর্থ নিগ্রহণ করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কনজারভেটিভরা প্যাটারসনের বিরুদ্ধে এই বহিষ্কারাদেশ স্থগিত রাখার পক্ষে ভোট দেয় এবং তার বিরুদ্ধে তদন্ত কীভাবে পরিচালিত হয়েছে তা অনুসন্ধানে আরেকটি নতুন কমিটি গঠন করে। শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদের মুখে ওয়েন প্যাটারসন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে প্রধানমন্ত্রী জনসন স্বীকার করেন যে এই বিষয়টি সামাল দিতে গিয়ে তিনি ‘দুর্ঘটনা ঘটিয়ে’ বসেছিলেন।
মনোযোগ আর উদ্ভাবনী চিন্তায় ঘাটতিঃ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ বা ‘ব্রেক্সিট কার্যকর করা হোক’ – এই সরল নীতির ওপর ভর করে সবশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করেছিলেন বরিস জনসন। অথচ তারপর থেকে ডাউনিং স্ট্রিটে মনোযোগে ঘাটতি ও নতুন ভাবনা-চিন্তার অভাব দেখা দেয় বলে জনসনের সমালোচকরা মনে করেন। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা, যিনি এখন তার প্রধান সমালোচকে পরিণত হয়েছেন, সেই ডমিনিক কামিংস বারবার অভিযোগ করে আসছেন যে প্রধানমন্ত্রী একটি নিয়ন্ত্রণহীন ‘শপিং ট্রলি’তে পরিণত হয়েছেন।
অন্যান্য সমালোচকেরাও প্রধানমন্ত্রীর দর্শন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে আদৌ তার কোনো দর্শন আছে কিনা। কনজারভেটিভ এমপি ও সাবেক মন্ত্রী জেরেমি হান্ট জুন মাসে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ‘একাগ্রতা, দক্ষতা ও লক্ষ্যের’ অভাবে ভুগছেন।জনসনের বিরুদ্ধে আস্থা ভোটের আগে দেওয়া বক্তব্যে জেরেমি হান্ট ওই অভিযোগ তোলেন, যা পরে আরও বেশি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।এছাড়া বরিস জনসন সরকার গঠনের পর থেকে ব্রিটেনের কয়েকটি উপনির্বাচনেও কনজারভেটিভদের পরাজয় ভরাডুইব হয়েছে। অবশ্য এখন কনজারভেটিভ এমপিদের জন্য এসব বিষয় আর উদ্বেগের কারণ নয়। তারা তাদের মতামত জানিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকেও বিদায় নিয়েছেন বরিস জনসন।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply