স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো ছিল রাজনীতির বাইরে। যুগের পর যুগ ধরে রাজনৈতিক ডামাডোলের বাইরে এ নির্বাচনগুলো হয়ে আসছে। হঠাৎ করে ২০১৫ সালে স্থানীয় নির্বাচন তথা পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পার্থীদের ‘দলীয় প্রতিক’ দিয়ে আইন করা হয়।
কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নৌকার প্রার্থীর বাইরে ডামি প্রার্থী তথা স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করে। এতে আওয়ামী লীগেরই ৫৮ জনসহ ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হন। ফলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ডামি প্রার্থী হিসেবে পরিচিত স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে শুরু হয়েছে বিরোধ।
এতে বেশ কয়েকজন প্রাণও হারিয়েছে। মাঠ পর্যায়ের এই দলীয় কোন্দল ঠেকাতে এখন নতুন করে স্থানীয় নির্বাচনের রাজনৈতিক দলের প্রতীক বরাদ্দ থেকে সরে আসছে সরকার। ফলে এবারের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক দলের প্রতীক থাকছে না। এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
গত বুধবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচন, ময়মনসিংহ সিটির সাধারণ নির্বাচন, ৯টি পৌরসভাসহ কয়েকটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড মিলে ২৩৩টি স্থানীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এসব নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ৯ মার্চ।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব জাহাংগীর আলম রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলনে তফসিল ঘোষণা দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর যেসব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হতে যাচ্ছে, তাতে দলীয় প্রতীক নৌকা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
তবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানানো হয়নি। সিটি করপোরেশনের মধ্য দিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী মনোনয়ন বা দলীয় প্রতীক না দিলে এ নির্বাচন তুলনামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করা হচ্ছে।
এ জন্য সিটি কর্পোরেশন সংশোধন) আইনের বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। আগামী সোমবার সিটি কর্পোরেশন সংশোধন) আইন, ২০২৪’র খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উঙ্খাপন করা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের (৪৮ক) দফা ‘‘রাজনৈতিক দল’’ সংজ্ঞা বাতিলের প্রস্তাব রেখে মন্ত্রিসভায় পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। (খ) দফা ঘ(৫৫) এর পর (৫৫ক) সন্নিবেশিত করা হয়।- (৫৫ক) বলা হয়, “স্বতন্ত্র প্রার্থী ” অর্থ এইরুপ কোন প্রার্থী যিনি রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নপ্রাপ্ত নহেন” এমন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ধারা পাস হলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে পারছেন না প্রার্থীরা।
গতবছর ৯ অক্টোবর সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন (ভোট) হবে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের তিন মাসের (৯০ দিন) মধ্যে। এমন বিধান রেখে ‘স্থানীয় (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) আইনে’র খসড়া অনুমোদন দিয়েছে কিন্তু তখন চুড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি মন্ত্রিসভা। বর্তমান আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের মেয়াদ ধরা হয় প্রথম সভা থেকে পরবর্তী ৫ বছর। আর কোনো সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ছয় মাসের (১৮০ দিন) মধ্যে ভোটগ্রহণ করতে হয়। সংশোধিত এই আইনটি পাস হলে সিটি করপোরেশন এলাকায় বৃষ্টিজনিত পানির ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজটি করবে সিটি করপোরেশন।
এখন এক ধরনের চুক্তির মাধ্যমে এই কাজটি সিটি করপোরেশন করছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ‘স্থানীয় (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) আইনে’র খসড়া অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের সচিবের পদের নাম পরিবর্তন করে ‘নির্বাহী কর্মকর্তা’ করা হয়েছে। এই পদটি সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা’র› নিচের পদ হবে। মেয়র ও কাউন্সিলরদের বছরের ছুটিও কমানো হচ্ছে। খসড়া অনুযায়ী, এখন মেয়র ও কাউন্সিলরদের ছুটি হবে বছরে এক মাস। এতদিন তাঁরা তিন মাস পর্যন্ত এই ছুটি নিতে পারতেন।
এ ছাড়া আগে কোনো কাউন্সিলেরর পদ ছুটিজনিত বা কোনো কারণে শূন্য হলে, পাশ্ববর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের ওই সময়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হতো। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী শূন্য হলে সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর এই দায়িত্ব পালন করবেন। সিটি কর্পোরেশনভুক্ত কোন ব্যক্তি মালিকানা বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার রাস্তা যথাযথভাবে সংস্কার বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করা হলে, জরিমানা করার ব্যবস্থা থাকবে। “খসড়া আইনে শিরোনাম ও প্রবর্তন।
এই আইন স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন,২০২৪ নামে অভিহিত হইবে।” “২০০৯ সালের ৬০ ন! আইন এর ধারা ২ এর সংশোধন।-স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন,২০১৫(২০০৯ সালের ৬০ নং আইন) এর ২ ধারা-এর (ক) দফা (৪৮) এর সন্নিবেশিত করে আইনের ধারা সংশোধন করা হয়। এতে (৪৮ক) “রাজনৈতিক দল” অর্থ রিপ্রেসেন্টেশন অব দ্যা পিপল অর্ডার-১৯৭২ আর্টিকেল-২ সংজ্ঞায়িত করে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নামে যুক্ত করা হয়।
(খ) দফা ঘ(৫৫) এর পর (৫৫ক) সন্নিবেশিত করা হয়।- (৫৫ক) বলা হয়, “স্বতন্ত্র প্রার্থী ” অর্থ এইরুপ কোন প্রার্থী যিনি রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নপ্রাপ্ত নহেন।”৬০ নং আইনের নতুন ধারা ৩২ক এর সন্নিবেশ করা হয় “নির্বাচনে অংশগ্রহণ-ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে, কোন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনে অংশগ্রণনের জন্য ব্যক্তিকে রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হইতে হবে।
” ধারা ৩৫ এর উপ-ধারা (২)এর পূর্বে উল্লিখিত বিদ্যমান বিধানটি উপ-ধারা (১) সংখ্যায়িত করে ২০১৫ সালে ২৬ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করা হয়। এবার সংশোধিত আইনে এসব ধারা বাতিল করে (খ) দফা ঘ(৫৫) এর পর (৫৫ক) সন্নিবেশিত করা হয়।- (৫৫ক) বলা হয়, “স্বতন্ত্র প্রার্থী ” অর্থ এইরুপ কোন প্রার্থী যিনি রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নপ্রাপ্ত নহেন” এমন বিধান যুক্ত করা হচ্ছে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ইনকিলাক বলেন, নির্বাচন কাঠামো ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক না থাকা ভালো সিদ্ধান্ত এবং আরও আগে এ আইন বাতিল করা দরকার। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আসলে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাই ঘটছে। পার্লামেন্টে তো আর বিরোধিতা করার কোনো কার্যকর দল নেই।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রয়োজনেই সব করছে। জনভাবনা বা জনদায় তো আর গুরুত্ব পায় না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক থাকা না থাকার বিষয়টিও ঠিক তাই। জানা গেছে, নয় বছর পর দলীয় প্রতীক ছাড়া এসব ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষ্য, তৃণমূলের রাজনীতিতে বিভাজন ঠেকাতে এবং শৃঙ্খলা রক্ষায় দলীয় প্রার্থী না দেওয়ার বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সবশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান পদ দুটি উন্মুক্ত রেখেছিল আওয়ামী লীগ। ২০১৫ সালের পর থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরুর পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিপাকেও পড়তে হয়েছে। অতীতে একজনকে প্রতীক দিলে আরেকজন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাতে দলীয় শৃঙ্খলা যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনই তৃণমূলে বিভেদ-বিভাজনও সৃষ্টি হয়েছে।
দলীয় সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বিপাকে পড়তে হয় প্রার্থী বাছাই নিয়ে। একেক নেতা একেক প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ায় কোথাও কোথাও পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে গড়িয়েছে। প্রতীক দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিতে ছিল না। ইতোমধ্যে গতকাল সোমবার গণভবনে আওয়ামী লীগের জরুরি কার্যনির্বাহী সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, উপজেলা নির্বাচনে আমরা দলের প্রতীকের প্রার্থিতা দেব কি না, এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সর্বসম্মত অভিমত যে, এবারকার উপজেলা নির্বাচনে আমাদের দলীয় প্রতীক নৌকা ব্যবহার না করা। নৌকা না দেওয়ার জন্য ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সবাই অভিমত পেশ করছেন।
আমাদের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, সবার অভিমতের সাথে আমি ভিন্নমত প্রকাশ করি না, যেহেতু সবাই এখানে একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন’। আগামী স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড (সভায়) এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। আপাতত এটা ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply