বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব-এর ৯৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ হাই কমিশন, লন্ডনে আয়োজিত “In Struggle and in Liberation, Bangamata is the Inspiration” শীর্ষক বিশেষ স্মারক অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম প্রখ্যাত ব্রিটিশ-বাংলাদেশি চিকিৎসক, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ হালিমা বেগম আলমকে ব্রিটেনে নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ অবদানের জন্য ‘Bangladesh High Commission, London Begum Fazilatun Nesa Mujib Women Empowerment Award 2023’ প্রদান করেন।
হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের সভাপতিত্বে স্মারক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকা থেকে অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুলতান মাহমুদ শরীফ ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবীর বিন আনোয়ার।
মহিলা ও শিশু-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, বঙ্গমাতা ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য সহধর্মিণী, সহকর্মী, সহযোদ্ধা এবং জীবনের চালিকা শক্তি। তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন ও প্রেরণা দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন । তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে নারীদের কর্মসংস্থানসহ নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রকৃত পথ প্রদর্শক ছিলেন।”
স্বাগত বক্তব্যে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও ১৫ আগস্টের সকল শহিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অনুপ্রেরণা। আর বঙ্গবন্ধুর মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন মহিয়সী বেগম মুজিব, যাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উপর বঙ্গবন্ধুর ছিলো অগাধ আস্থা। ‘৪৮ ও ‘৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬৬‘র ছয় দফা, ৬৮‘র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের পুনর্গঠনসহ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গমাতা বঙ্গন্ধুর একজন সুযোগ্য সহযোদ্ধা হিসেবে নি:স্বার্থভাবে যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন সেজন্য তিনি বাঙ্গালির ইতিহাসে স্বমহিমায় চির-ভাস্বর হয়ে থাকবেন। তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই শিক্ষা, আদর্শ ও চেতনাকে অবলম্বন করে বাংলাদেশকে আজ নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে গড়ে তুলেছেন।”
তিনি আরো বলেন, “যুক্তরাজ্যে তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গমাতার জীবন, কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে জানাতে ও অনুপ্রাণিত করতেই বাংলাদেশ হাই কমিশন, লন্ডন তাঁর নামে পুরস্কার প্রবর্তন করেছে এবং ডাঃ হালিমা বেগম আলমের মতো মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী, প্রগতিশীল ও ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির শ্রদ্ধেয় নারীকে এই পুরস্কার প্রদান করেছে। হাইকমিশনার তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গমাতার সংগ্রামী জীবন, কর্ম ও আদর্শ অনুসরণ করে যুক্তরাজ্যে প্রবাসি বাংলাদেশি নারীদের ক্ষমতায়নে সম্পৃক্ত হয়ে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির ও প্রবাসে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বঙ্গমাতাকে খুব কাছে থেকে দেখার স্মৃতিচারণ করে বলেন, “বঙ্গমাতা অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য অসাধারন অবদান রেখে গেছেন । পরিবার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নির্মোহ, অবিচল ও সাহসিকতার সঙ্গে তিনি সবসময় দেশ ও জাতির স্বাধিকার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন।”
বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবীর বিন আনোয়ার অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও বিশিষ্টজনের বিভিন্ন লেখা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুর জীবনে বঙ্গমাতার অপরিসীম ও ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।
যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুলতান মাহমুদ শরীফ ব্রিটেনে প্রবাসী তরুণ-তরুণীদের বঙ্গমাতার সহজ-সরল জীবন ও আদর্শ থেকে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানান।
পুরষ্কার গ্রহনের পর আবেগাপ্লুত ও অশ্রুসিক্ত ডাঃ হালিমা বেগম আলম বলেন, বাংলাদেশ হাই কমিশন, লন্ডনের এই বিরল ও আশাতীত সম্মাননা তাঁর জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বঙ্গমাতাকের নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘শেখ মুজিবের রেণু’-র উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বঙ্গমাতা ছিলেন বাঙ্গালি নারীদের ধ্রুবজ্যোতি এক অনন্য ও অসাধারণ নারী। তাঁর মতো এমন দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মমতাময়ী নারী আর একজনও আমি আমার জীবেন আজ পর্যন্ত দেখিনি।”
উল্লেখ্য, ডাঃ হালিমা বেগম আলম ১৯৫১-১৯৫৫ সেশনে মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে (বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) অধ্যয়ন করেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্টেট মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি থেকে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে জিপি এবং প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন-এর উপদেষ্টা চিকিৎসক নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিলেতে আন্দোলনের প্রথম সারিতে থেকে তিনি অন্যান্য নারীদেরও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করেন।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ক্যামডেনের মেয়র কাউন্সিলর নাজমা রহমান, রেডব্রিজের মেয়র কাউন্সিলর জ্যোৎস্না রহমান ইসলাম ও ব্রেন্ট কাউন্সিলের কাউন্সিলর রীতা বেগম। তাঁরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রখ্যাত নারীদের সাথে বঙ্গমাতাকে তুলনা করে বাঙ্গালি জাতি গঠনের ইতিহাসে সবচেয়ে সাহসী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারী হিসেবে তাঁর জীবন, কর্ম ও অবদান সম্পর্কে আরো গবেষণা ও প্রকাশনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বঙ্গমাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে ও তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণের মাধ্যমে তাঁর প্রতি গভীর শুদ্ধা জানানো হয়। এ উপলক্ষে বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বঙ্গমাতাকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীন।
অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের মূলধারায় ব্রিটিশ-বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মের জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।