দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে দাবি-দাওয়া জানিয়েও পদোন্নতি পাচ্ছেন না দেশের বিভিন্ন উপজেলা ও থানা পর্যায়ের দুই হাজার ৬০০ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে এখন থেকে এই কর্মকর্তাদের আর কেউই নিজ জেলায় দায়িত্ব পালনও করতে পারবেন না। তাদের প্রত্যেককেই অন্য জেলায় বা উপজেলায় বদলি করা হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে শিক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে। ইতোমধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সংবলিত স্মারকলিপিও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বরাবরে জমা দিয়েছেন বঞ্চিত ও বিক্ষুব্ধ উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা।
সংক্ষুব্ধ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের অনেকেই জানান, প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানের সার্বিক দায়িত্বে থাকা সহকারী উপজেলা/ থানা শিক্ষা কর্মকর্তারা (এইউইও/ এটিইও) ২৮ বছর ধরে চাকরি করছেন একই গ্রেডে। সীমিত করে দেয়া হয়েছে তাদের পদোন্নতির সুযোগও। ফলে হতাশায় ভুগছেন দুই হাজার ৬০১ জন শিক্ষাকর্মকর্তা। তাই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সহকারী শিক্ষাকর্মকর্তাদের দশম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে উন্নীত করাসহ শতভাগ পদোন্নতির সুযোগ প্রদানের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার অ্যাসোসিয়েশন।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মৌলিক এই দু’টি দাবিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে স্মারকলিপি ও চিঠি দিয়েছে। একই সাথে সম্প্রতি সহকারী উপজেলা/ থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নিজ জেলার বাইরে বদলির মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তও বাতিলের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৮৫ সালে নিয়োগ বিধিমালার পরে ১৯৯৪ সালে এইউইও পদটি ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয় এবং সে সময়ে তার অধস্তন প্রধান শিক্ষক পদটি ১৪তম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষক পদটি ১৮তম গ্রেডে ছিল। প্রধান শিক্ষক পদটি তিন দফায় উন্নীত করার ফলে ২০১৪ সালে ১১তম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষক পদটি চার দফায় ২০২০ সালে ১৩তম গ্রেডভুক্ত হয়। একই সময়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদটি ৯ম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে, পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট পদটি নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে এবং পিটিআই ইন্সট্রাক্টর পদটি তৃতীয় শ্রেণী থেকে নবম গ্রেডে উন্নীতকরণ করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ২৮ বছর পর্যন্ত সহকারী উপজেলা/ থানা শিক্ষাকর্মকর্তা পদটি ১০ম গ্রেডেই রয়েছে।
এ দিকে ১৯৮৫ সালের নিয়োগবিধি অনুযায়ী, উপজেলা সহকারী শিক্ষাকর্মকর্তা পদ থেকে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির সুযোগ ছিল ৫০ শতাংশ। কিন্তু ১৯৯৪ সালে সেটি কমিয়ে করা হয়েছে ২০ শতাংশ। অথচ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষা কর্মকর্তা পদে নিয়োগের যোগ্যতা ও পদ্ধতি একই। শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার তৃণমূলের নিকটতম কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী উপজেলা/ থানা শিক্ষা কর্মকর্তা (এইউইও/ এটিইও) প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক এবং বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। একই সাথে তাদের তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতা করে থাকেন। এ ছাড়া মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী চালুকরণ, ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীতকরণ, শতভাগ শিশু ভর্তির কারণে শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি, সব শিক্ষকের গ্রেড উন্নীতকরণ ইত্যাদিও যুক্ত হয়েছে তাদের দায়িত্বে। প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান, শিক্ষার মান নিয়েও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয় এসব কর্মকর্তাকে।
সম্প্র্রতি মন্ত্রণালয় নিজ জেলার বাইরে এটিইও বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ এস রবিউল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, নবম গ্রেড দিলে দেশের কোথাও যেতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, নিজ জেলার বাইরে দিলেই কি শিক্ষার মান রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবে? পরিবার-পরিজন ছেড়ে অন্যত্র চাকরি করে কি তাদের শতভাগ সেবা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করতে পারবে? বরং নিজ জেলায় পরিবারের সাথে থেকেই এখন যেভাবে এইউইও/ এটিইওর কাজ করছেন সেটিই বহাল রাখলে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি সম্ভব। তিনি বিভিন্ন উপজেলা বা থানায় কর্মরত মহিলা সহকারী উপজেলা/ থানা শিক্ষা অফিসারদের জন্য দ্রুত স্কুটির ব্যবস্থা করারও দাবি জানান। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসাররা বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক, আর্থিক ও অবকাঠামোগত সব ধরনের কাজের মনিটরিংয়ের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। তাই নারী কর্মকর্তাগণের কাজের সুবিধার্থে স্কুটির ব্যবস্থা করা দরকার।
অন্য দিকে বাংলাদেশ সহকারী উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: সালাহউদ্দিন আহমেদ নয়া দিগন্তকে জানান, ১৯৯৪ সাল থেকে আমরা একই গ্রেডে কাজ করে আসছি। অথচ আমাদের অধীনে থাকা প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের দফায় দফায় গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট এবং পিটিআই ইন্সট্রাক্টরদেরও গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে। তাই এ পদটি নবম গ্রেডে উন্নীত করার যৌক্তিকতা অপরিসীম। তিনি বলেন, এইউইও/ এটিইওর বদলির খবরে মাঠপর্যায়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করি সরকার মাঠ পর্যায়ের সঠিক চিত্র অনুধাবন করতে পারবেন এবং নিজ জেলার বাইরে বদলির যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন সেটি পরিবর্তন করবেন। মাঠ পর্যায়ে এ নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, আমাদের সহকর্মীরাই যেমন সমাজসেবা অফিসার নবম গ্রেডের, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবম গ্রেডের এমনকি যুব উন্নয়ন অধিদফতরের প্রধান নিজ জেলায় কর্মরত। তাহলে আমরা কেন নয়? বরং নিজ জেলায় পরিবারের সাথে থেকেই এখন যেভাবে এইউইও/ এটিইওর কাজ করছেন সেটিই বহাল রাখলে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি সম্ভব।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো: আমিনুল ইসলাম বলেছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশুনার মান সন্তোষজনক নয়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী যার যার শ্রেণীর সাধারণ পড়াগুলো পারার কথা, কিন্তু সেগুলোও পারছে না। অনেক শিক্ষক অনুপস্থিত থাকছেন, বেশির ভাগই উপজেলা বা জেলা শহরে বাস করছেন। ফলে শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আর শিক্ষকরা এ সুযোগটি নিচ্ছেন সহকারী উপজেলা/ থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাহায্যে। এজন্য মন্ত্রণালয় তাদের নিজ জেলার বাইরে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সূত্র. দৈনিক নয়াদিগন্ত