৯৬ বছরে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মৃত্যুবরণ করেছেন। রানির মৃত্যুর খবর কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে, সে সম্পর্কে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল (বৃহস্পতিবার) ব্রিটেনে নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্বিতীয় দিন ছিল। সেদিন তিনি পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগ দেন। অধিবেশনে লিজ ট্রাসের নতুন জ্বালানি পরিকল্পনা নিয়ে তাকে বিরোধী দলের নেতা কেয়ার স্টারমার প্রশ্ন করছিলেন। সেসময় স্টারমারকে তার সহকারি হলুদ একটি কাগজ দেন।
এর কয়েক মিনিট পরেই ট্রাস এবং স্টারমার পার্লামেন্ট কক্ষ ত্যাগ করেন। তখনই পার্লামেন্ট ভবনে গুঞ্জন শুরু হয় যে কিছু একটা ঘটেছে। পার্লামেন্ট ভবনে উপস্থিত এক সাংবাদিক টুইটারে জানান, উভয় নেতা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনেক আইনপ্রণেতাকে বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। উভয় নেতা যখন পার্লামেন্ট কক্ষ ত্যাগ করেন তখন লন্ডনের স্থানীয় সময় ১২ টা বেজে ২১ মিনিট।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ২০২১ সালে ৯৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আর গত কয়েক বছরে রানি বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। একারণে তিনি জনসম্মুখে আসাও কমিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা মাথায় রেখে কীভাবে রানির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হবে সে বিষয়ে গত কয়েক বছরে রয়েল পরিবার, ব্রিটিশ সরকার এবং বিবিসি মিলে বহু গোপন পরিকল্পনা করেছিল।
ফাঁস হওয়া কয়েকটি গোপন নথি থেকে দেখা যায়, প্রতি ছয় মাস পর পর বিবিসি ‘অপারেশন লন্ডন ব্রিজ’ শিরোনামে একটি আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রামের অনুশীলন (রিহার্সেল) করত। এর উদ্দেশ্যে ছিল রানির মৃত্যুর খবর কীভাবে জাতিকে জানানো হবে তার মহড়া দেওয়া।গত বছর মার্কিন সংবাদমাধ্যম পোলিটিকো এক প্রতিবেদনে জানায়, রানির মৃত্যুর খবরকে ‘ডি-ডে’ সাংকেতিক চিহ্ন হিসেবে বর্ণনা করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, গতকাল পার্লামেন্টেও ‘ডি-ডে’ লেখা চিঠি গিয়েছিল। যদিও অন্য উপায়ে খবর পৌঁছানোর সম্ভাবনাও থাকতে পারে।
লন্ডনের সময় অনুযায়ী ১২টা ৩৪ মিনিটে বাকিংহাম প্যালেসের পক্ষ থেকে রয়েল ফ্যামিলির টুইটার অ্যাকাউন্টে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিটি ২৯ শব্দের দীর্ঘ ছিল। সেখানে রানি চিকিৎসকদের পরামর্শে মেডিকেল পর্যবেক্ষণে রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়।ওই টুইটের পরই চারিদিকে রানির স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। বিবিসি তাদের ওয়েবসাইটে রানির স্বাস্থ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সরাসরি খবর প্রকাশ শুরু করে। পরে বাকি সংবাদমাধ্যমগুলোও নিজ নিজ ওয়েবসাইটে সরাসরি বাকিংহাম প্যালেস থেকে খবর প্রকাশ শুরু করে।
তারপর লন্ডনের সময় অনুযায়ী ১টা ৪৮ মিনিটে বিবিসি তাদের নিয়মিত প্রোগ্রাম স্থগিত করে। বিখ্যাত উপস্থাপক হাউ এডওয়ার্ড কালো রংয়ের স্যুট এবং কালো টাই পড়ে স্ক্রিনের সামনে আসেন। তখন তিনি শুধুমাত্র রানির স্বাস্থ্যের খবর পাঠ করেন। এসময় বাকিংহাম প্যালেসের বাইরে উপস্থিত সাংবাদিকদেরও কালো রংয়ের টাই পড়তে দেখা যায়।এর কিছুক্ষণ পরেই রয়েল ফ্যামিলির সদস্যদের কয়েকজনকে বাকিংহাম প্যালেসে পৌঁছাতে দেখা যায়। এসময় তাদেরকে খুবই বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। তারপরই বিভিন্ন টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে রানির মৃত্যুর নিয়ে ভুয়া পোস্ট প্রকাশ পেতে থাকে।
২০১৬ সালেও বিবিসির অ্যাকাউন্ট থেকে টুইটারে রানির মৃত্যুর খবর প্রকাশ হয়। পরে টুইটার কর্তৃপক্ষ খবরটি গুজব হওয়ায় তা ডিলিট করে দেয়।এর এক বছর আগে বিবিসির এক সাংবাদিক রানির মৃত্যু নিয়ে আরেকটি পোস্ট করেন। তারপর ওই পোস্টটিও দ্রুত ডিলিট করে দেওয়া হয়। তখন বিবিসি এক বিবৃতিতে জানায়, রানির মৃত্যু নিয়ে একটি কারিগরি রিহার্সেলের জন্য ওই পোস্টটি করা হয়েছিল।কিন্তু গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিবিসির কর্মকাণ্ডকে মহড়া (রিহার্সাল) মনে হচ্ছিল না। গতকালও লন্ডন সময় অনুযায়ী বিকাল ৩টা ৭ মিনিটে বিবিসির উপস্থাপক ইয়ালদা হাকিম একটি টুইট করেন।
তিনি লিখেন, ‘ব্রেকিং: রানি এলিজাবেথ ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন, বাকিংহাম প্যালেস ঘোষণা দিয়েছে।’এর কিছুক্ষণ পরেই টুইটটি ডিলেট করেন তিনি। এর পর তিনি টুইটটি সংশোধন করে লিখেন, রানির মৃত্যুর খবর নিয়ে বাকিংহাম প্যালেস থেকে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। একারণে তিনি পোস্টটি ডিলিট করেছেন। তখন সময় ৩টা ১৯ মিনিট।পরে যত সময় যাচ্ছিল রয়েল ফ্যামিলির বাকি সদস্যরা বাকিংহামে প্যালেসে আসতে থাকেন। এসময় রানির নাতি প্রিন্স উইলিয়ামকে তার সন্তান অ্যান্ড্রু এবং এডওয়ার্ড ও তার স্ত্রী সোফিকেও দেখা যায়।
বিবিসির ‘অপারেশন লন্ডন ব্রিজের’ পক্ষ থেকে আগে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে রানির মৃত্যুর খবর সন্ধ্যায় যেন প্রকাশ করা না হয়। দেশটির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকও জানিয়েছিলেন, সকাল (শুক্রবার) হওয়ার আগ পর্যন্ত বাকিংহাম প্যালেস থেকে নতুন কোনো ঘোষণা আসবে না।
কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।রানির মৃত্যুর খরব নিয়ে গুঞ্জন শুরু হওয়ার ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় পরে আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সন্ধ্যা ৬টা ৪১ মিনিটে রয়েল ফ্যামিলি টুইটার অ্যাকাউন্টে রানির মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়। আর রয়েল ফ্যামেলির ওয়েবসাইট কালো করে দেওয়া হয়। সেখানে শুধু রানির একটি ছবি দেওয়া হয় ও মেসেজ লেখা ছিল, ‘রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯২৬-২০২২’। আর তখনই রানির মৃত্যুর খবরটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়। আর পুরো বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply