ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি আর বাইডেনের অপ্রয়োজনীয় বাহাদুরি দেখানোর নীতি-পলিসির পতন- এসব ব্যর্থতা কি আসন্ন? অবস্থা যেন ক্রমেই সেই অভিমুখেই হাঁটছে!
ইউক্রেন যুদ্ধকে, ইইউর নেতারা গত ২৪ ফেব্রুয়ারিতে এটি শুরু হওয়ার পর থেকে একে ‘রাশিয়ান আগ্রাসনের যুদ্ধ’ বলে আসছেন। কিন্তু টনি ব্লেয়ারের কথা আমরা নিশ্চয় ভুলে যাইনি। এককালে যার প্রধান পরিচয় হয়ে উঠেছিল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট (২০০১-৮) জুনিয়র বুশের কুখ্যাত ওয়্যার অন টেররের কালে ইনি তার ঘনিষ্ঠতম সাগরেদ; সহযোগী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী (১৯৯৭-২০০৭) ছিলেন এই টনি ব্লেয়ার। তারা যৌথভাবে ইরাকে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে মিথ্যা অস্ত্র মজুদের কথা বলে ‘রেজিম চেঞ্জ’ তত্ত্বে ইরাকে হামলা ও দখল করেন; পরে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করেন ও ফাঁসিতে ঝোলান।
সম্প্রতি সেই টনি ব্লেয়ার এবার আবার রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। ‘ইউক্রেনের পরে, পশ্চিমা নেতৃত্বের জন্য কী শিক্ষা হলো?’ এই শিরোনামে ব্রিটেনে আহূত এক সভার বক্তৃতায় টনি ব্লেয়ার বলেছেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ দেখাল দুনিয়ার ওপর পশ্চিমা আধিপত্যের দিন শেষ হওয়ার পথে যেহেতু দুনিয়াতে নয়া সুপার পাওয়ার হিসেবে চীনের উত্থান ও আসীন হওয়া ঘটছে; এই চীনের পার্টনার হলো রাশিয়া। তবে এই শতাব্দীর এটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মোড় পরিবর্তন।’
তিনি যেন সব খোলাখুলি বলে ফেলতে চাইছেন, আর মিথ্যার টেনশন নিতে পারছেন না। তাই বলছেন, ‘দুনিয়ার ইতিহাস এক মোড় পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেছে যা একমাত্র তুলনা করা সম্ভব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার সাথে। শুধু ফারাকটা এই যে, পশ্চিম আর এবার উপরে উঠছে না, বরং পরিষ্কারভাবেই পতিত, নিচে নামছে। পরিষ্কারভাবেই আমরা পশ্চিমারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পতনের প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছি।’
এই কথাগুলোই আমি এতদিন বলে আসছি, সেই ২০১৪ সাল থেকে। আর বলেছি, ‘এই মোড় পরিবর্তন ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী হিসেবে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্বে উত্থান যেমন ঘটেছিল কেবল তার সাথেই তুলনীয়। আমেরিকান নেতৃত্ব লাভের ৭৫ বছর পরের এ ঘটনা; এর সাথে পার্থক্য কেবল আমেরিকার জায়গায় এবারে চীনের উত্থান ঘটছে।’ সাথে এটিও বলেছিলাম, এসবের মূল কথাগুলো আমার কথা একেবারেই নয়। বরং আমেরিকান নিজস্ব সার্ভে-স্টাডি রিপোর্টের ফাইন্ডিংস থেকে পাওয়া।
লক্ষণীয়, এখানে আমি ‘চীনের ফাইন্ডিংস’ বলিনি। তবু আমেরিকান-প্রীতিতে লোকেরা এর অর্থ করেছিল যে, আমি আমেরিকাকে দেখতে পারি না আর ওদিকে, কমিউনিস্ট বলে চীনকে পছন্দ করি, তাই এসব বলেছি।
তাই আমি আবার এও বলেছিলাম, কোনো রাষ্ট্রের এমন অর্থনৈতিক উন্নতি; এটি একেবারেই অবজেকটিভ ঘটনা। মানে, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা ভূমিকম্প যেমন কর্তা-মানুষের ইচ্ছায় ঘটে না; এসব অবজেকটিভ ঘটনা। যুদ্ধ লাগাব বা লড়ব বলে ঝাঁপিয়ে পড়া যেমন সাবজেকটিভ ঘটনা- এটি তেমন নয়। কোনো দেশের শাসককুল আগ্রহ করে যুদ্ধ লাগাতে পারে কিন্তু বাস্তব সুযোগ থাকাসহ অনেক কিছুই আলোচ্য ঘটনাবলিতে অবজেকটিভ বাস্তবতা হয়ে থেকেছে। তাই মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হওয়া মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপার নয় বরং ‘বাস্তব করে দেখানোর’ ব্যাপার।
সে যাই হোক, আমরা দেখছি বুশের সহযোগী ব্লেয়ার, এখন আগেভাগেই সব স্বীকার করে নিলেন। বিশেষত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন এখনো জিদ আর সাদা শাসনের স্বপ্নে বিভোর আছেন! ওদিকে পরিচিত আর বড় নেতাদের মধ্যে এর আগে জিমি কার্টারের আমলের আমেরিকান এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সেক্রেটারি অব স্টেট (১৯৭৭-৮১) ব্রেজনেস্কি; (তনরমহরবি ইৎুবুরহংশর), আমার জানা মতে তিনিও প্রথম এমন স্বীকারোক্তি করেছিলেন।
অর্থাৎ টনি ব্লেয়ার এ ক্ষেত্রে সমসাময়িকদের চেয়ে এগিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা দেখলাম। আর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন? তিনি ব্লেয়ারের উল্টা! জিদ ধরলেন; আর যদিও ইতিহাস বলে এটি একেবারেই জেদাজেদি বা প্রতিহিংসার বিষয়ই নয়। বাইডেনের ক্ষমতায় আসার আগের বোকা অবাস্তব সাফাই-যুক্তি ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প বোকা গোঁয়ার ও আরেক জেদি, তাই ট্রাম্প নাকি আমেরিকার হাতে এখনো কী কী অস্ত্র আছে তাই-ই জানেন না। বিপরীতে, বাইডেন যেন তা জানেন। আর সেগুলো ব্যবহার করে বাইডেন দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে পারবেন যে, আমেরিকার দিন শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু আমেরিকার হাতের কী বিশেষ অস্ত্র যা তাকে এখনো গ্লোবাল নেতৃত্বে আসীন করে রাখবেই বলে তার নিজের অনুমান?
বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে নামিয়ে এরপর আমাদের দেখালেন তার চোখে আমেরিকার সঞ্চয়ে থাকা বিশেষ অস্ত্রগুলো কী কী? তিনি খুলে দেখালেন ‘ডলার অবরোধ’ আর মানবাধিকার- এই দুটো আমেরিকার হাতের অস্ত্র যা বাইডেন আমেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর (অবশ্যই তা অপব্যবহার, তাহলেও) তিনি তা প্রয়োগ করে তাদের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাবু করে ফেলে, সারেন্ডার করতে বাধ্য করে জিতে যাবেন।
এখানে ‘ডলার অবরোধ’ মানে হলো, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে মার্কিন ডলারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না দেয়া বা ওসব দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগতভাবেও ডলারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ওই রাষ্ট্রের অর্থনীতিকেই বাইডেন সহজেই ধসিয়ে দেবেন। যেহেতু ডলার গ্লোবাল বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা, তাই তিনিই সফল হবেন।’ এই ছিল বাইডেনের মূল অনুমান!
অন্য দিকে, মানবাধিকার বলতে, বাইডেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলবেন। জেনুইন কেউ কারো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলতেই পারে। এর উপযুক্ত ফোরামও আছে, সেটি হলো জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার অফিস। কিন্তু এখানে বাইডেন তা তুলবেন নিজ রাষ্ট্রের তরফে আর মানবাধিকারকে নিজ পররাষ্ট্রনীতির অংশ করে নিয়ে, আর এর শাস্তিও দেবেন নিজেই। তাই সত্যিই ওই রাষ্ট্র মানবাধিকার চরম লঙ্ঘনের দেশ হলেও- আমেরিকার এই অভিযোগ তোলার স্বচ্ছতায় সমস্যা থেকেই যায়। মানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ জেনুইন হলেও এই অভিযোগ তুলে একে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে ফায়দা তোলা- বাইডেন এই অপব্যবহারের দিকটিই এখানে প্রধান।
এ ছাড়া বাইডেন তো পরিষ্কার করেই বলছেন, চীনের অর্থনৈতিক উত্থান ও গ্লোবাল লিডারশিপ ক্রমেই আসন্ন হয়ে উঠলেও তিনি তা মানবেন না। উল্টা, ঠেকানোর জন্য লড়বেন।
অর্থাৎ তিনি অপব্যবহার করবেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই চীনের অর্থনৈতিক উত্থান ও গ্লোবাল লিডারশিপে বদল আসন্ন হয়ে ওঠা- এই বিষয়গুলো কি আমেরিকার সরকারি দলিলে স্বীকার করা হয়েছে? কোনো আমেরিকান সরকারই বা কি এটি স্বীকার করেছে?
বাস্তবতা হলো, অবশ্যই স্বীকার করেছে। শুধু তাই নয়, এ নিয়ে সার্ভে-স্টাডি রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে গত ২০০৮ সাল থেকে নিয়মিতভাবে। গ্লোবাল ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস নামে যেমন গ্লোবাল ট্রেন্ড ২০০৮ নামে ২০২৫ সালের দুনিয়া কেমন দেখতে হবে এ নিয়ে। আবার, গ্লোবাল ট্রেন্ড ২০১২ নামে ২০৩০ সালের দুনিয়া কেমন, গ্লোবাল ট্রেন্ড ২০১৭ নামে ২০৩৫ সালের দুনিয়া কেমন এভাবে নিয়মিত রিপোর্ট বের হয়ে এসেছে। আর মজার কথা হলো, এসব কোনো রিপোর্টেই, এই ট্রেন্ড বা গ্লোবাল অভিমুখগুলোকে গায়ের জোরে কোনো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কি রোধ করতে বা ঠেকাতে যাওয়া উচিত অথবা যাওয়া সম্ভব?
না, তা একেবারেই ওসব রিপোর্টে উৎসাহিত করা হয়নি। বরং অবজেকটিভ ঘটনা হিসেবে সেগুলো উপস্থাপিত হয়েছে। যদিও বুশের আমল থেকে শুরু করে ট্রাম্প এবং বাইডেন পর্যন্ত এই আসন্ন বদলকে উল্টে দিতে সব প্রেসিডেন্টেই চেষ্টা-পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছেন, আমরা দেখছি। যেমন বুশের আমল থেকে চীনের উত্থান ঠেকাতে ভারতকে সুবিধা, পিঠ চাপড়ানি দিয়ে ভারতকে ব্যবহার করা। চীন ঠেকাতে ভারতকে ঠিকা দাও, এই নীতিকে বুশসহ পরবর্তী সব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অনুসরণ করে চলে এসেছেন। কিন্তু কোনো ফলাফল না দেখে ভারতকে সুবিধাদি দেয়া বন্ধ করেছিলেন (২০১৭) একমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পই। আর বাইডেন এসে ভারতের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন মুখেই কিন্তু কোনো অবরোধ আরোপ কখনোই করেননি এখনো।
সার কথায়, চীনা অর্থনৈতিক উত্থান কোনো কিছুতেই ঠেকবে না- তা জেনেও সব মার্কিন প্রেসিডেন্টই কমবেশি ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে লেলানোসহ নিজেই চীনের বিরুদ্ধে নানা কিছুই করে গেছেন, যাচ্ছেন যার আবার একটি হলো, বাংলাদেশকেও ভারতের হাতে তুলে দেয়া। আর বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে নামিয়ে এরপর আমাদের দেখাতে চেয়েছিলেন রাশিয়ার ওপর ইউরোপের ইউরো আর আমেরিকান ডলার অবরোধ করে কত সহজেই তিনি রাশিয়াকে পরাস্ত করে ও মাফ চাওয়াতে বাধ্য, তারা ঘটাতে পারেন। কিন্তু হায়! রাশিয়ান অর্থনীতি সস্তায় সহজেই ডুবে যাওয়ার বদলে রাশিয়ান মুদ্রা রুবল এখন উল্টা শক্তিশালী হয়েছে। অর্থাৎ ইইউ-আমেরিকা এদের মিলিতভাবে, বাইডেনের ভাষায় তারা ‘ওয়েস্টার্ন ফোর্স’, বিজয়ের বেশে হাজির হবেন- এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন দূরে থাক নিজেদের ইজ্জত বাঁচানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ইইউর এই ব্যর্থতার মূল কারণ হলো- ইউরোপের রাশিয়ার ওপর জ্বালানিনির্ভরতা সীমাহীন। এটি বাস্তব। আর এটিই তারা স্বীকার না করে গায়ের জোর দেখাতে গেছেন। এই কঠোর বাস্তবতার কারণেই বাইডেনের সব বাহাদুরি এক ফাজলামিতে পরিণত হয়েছে। বহুবার বহুভাবে ইইউ নিজে এই নির্ভরতার দিকটা বাইডেনের সামনে তুলে ধরে দেখিয়েছেন। বলেছেন, এখন এই নির্ভরতা কাটাতে উদ্যোগ নেয়া শুরু করলেও ২০২৭ এর শেষেই একমাত্র ফল পাওয়া মানে ইইউর রাশিয়ানির্ভরতা কাটতে পারে। কিন্তু বাইডেনের জিদের কাছে ইইউও হার মেনেছে, অসহায় হয়ে থেকেছে। ইইউর ২৭টি রাষ্ট্র ঠিক কী কারণে কোন জাদুতে বাইডেনের কথার উপরে কথা বলার ‘ভয়েজ নাই’ হয়ে গিয়েছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর লাগে।
অনুমান করা হয়, চীন গ্লোবাল নেতা হয়ে গেলে দুনিয়া থেকে গত পাঁচ-ছয় শ’ বছরের টানা সাদা চামড়ার শাসন বা সাদা ককেশীয় শাসন, এমন এথনিক বর্ণবাদের আধিপত্য লোপ যাতে না পায় এ জন্য ইইউকে বাইডেনের আমেরিকার সাথে বেঁধে নিয়ে জিদ্দি ঝড় তোলেন- মানে ইইউর সবাই এথনিক বর্ণবাদের আধিপত্য দেখানোর লোভে পড়েছিলেন! আর এটি কি এতই তীব্র যে, ২৭ রাষ্ট্রের ইইউর সবাই লোভে পড়ে বোকা আর বোবা হয়ে গেল- এটি ভাবতেও অবাক লাগে! অথচ এরাই এই কথিত ‘ওয়েস্টার্ন ফোর্স’ গত মাসেও তাদের মূল্যবোধ নাকি শ্রেষ্ঠ এই বলে খুব গর্ব দেখিয়েছে! অথচ আগামী শীতে ইউরোপ জ্বালানি কোথা থেকে পাবে এর কোনো সংস্থান কথিত ‘ওয়েস্টার্ন ফোর্স’ এখনো করতে পারেনি। অর্থাৎ আগামী উইন্টারে প্রতিটি ইউরোপবাসীকে ঘর গরম রাখার সংস্থান হয়নি বলে ঠাণ্ডায় ঠকঠকিয়ে কাঁপতে হবে নয়তো ঘরবাড়ি ছেড়ে গরমের সন্ধানে যেতে হবে।
বড় হামবড়া মুখের বাইডেন তাই নিজেই মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়েছিলেন গত ১৬ জুলাই। সৌদি আরবের জেদ্দাতে ১০ আরব দেশের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ছিল বাইডেনের সেই বৈঠক। ১০ আরব দেশ বলতে সৌদি, ইউএইসহ ছয় গালফ স্টেট আর সাথে মিসর, জর্দান ও ইরাক এবং সাথে বাইডেনের আমেরিকা (সাথে দ্বিপাক্ষিকভাবে আমেরিকা-ইসরাইল)।
বাইডেনের উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক. ইউরোপের জন্য বাড়তি তেল-গ্যাস জ্বালানির ব্যবস্থা করা যায় কি না আর সাথে দুই. গ্লোবাল জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম দেয়া যাতে দুনিয়াব্যাপী যে মুদ্রাস্ফীতি জাগিয়ে বাইডেন কৃতিত্ব রেখেছেন এর দায়দায়িত্ব তিনি কিছু লাঘব করতে পারেন; তার জিদ্দি অবিবেচক সিদ্ধান্তের দায়ভার কিছুটা কমে। কিন্তু হায়, সেটাই ব্যাক ফায়ার করেছে। সৌদি আরবের বর্তমান বাদশা বেঁচে থাকলেও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (সংক্ষেপে এমবিএস ডাকা হয়) কার্যত সৌদি আরবকে এখনই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এখানে নিচে সেই সভায় এমবিএস যে জবাবটা দিয়েছিলেন সেই বক্তৃতার সারাংশ নিয়ে রয়টার্সের রিপোর্টের, আমার নিজের করা, অনুবাদ তুলে দিয়েছি।
গত ১৬ জুলাইয়ে রয়টার্স লিখছে : ‘সৌদি যুবরাজ ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান শনিবার বলেছেন, ফসিল ফুয়েল (মাটির নিচের তেল) খাতে আরো বিনিয়োগ প্রয়োজন ও গ্লোবাল চাহিদা মেটানোর মতো শুদ্ধ জ্বালানি টেকনোলজি দরকার এবং অবাস্তব জ্বালানি নিঃসরণ পলিসি নিলে তা আমাদের অকল্পনীয় পর্যায়ের মুদ্রাস্ফীতির দিকে নেবে; জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে দেবে, বেকারত্ব বাড়াবে এবং সমাজ ও নিরাপত্তার প্রশ্নকে আরো দুর্বল করবে।’
‘সৌদি যুবরাজ তার দেশের তেল উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বলেন, এটি ২০২৭ সালের মধ্যে দৈনিক ১৩ মিলিয়ন ব্যারেল পর্যন্ত বাড়াবেন যা এখন ১২ বিলিয়ন সক্ষমতায় আছে। আর এরপর আমাদের কিংডমের আর বাড়ানোর কোনো সক্ষমতা অবশিষ্ট থাকবে না।’
তিনি এসব কথা বলছিলেন জেদ্দায় আমেরিকা ও আরবদের নিয়ে এক শীর্ষ সম্মেলনে যেখানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উপস্থিত ছিলেন। বাইডেন আসলে আশা করে এসেছিলেন, সৌদি আরব ও তার ওপেক পার্টনাররা বাজারে আরো বেশি তেল ছাড়ুক যাতে জ্বালানি তেলের মূল্য নেমে আসে, যাতে এর প্রতিক্রিয়ায় চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে উপরে উঠে যাওয়া মুদ্রাস্ফীতি নেমে আসে, জীবন সহজ হয়। এমবিএস স্পষ্টতই দুনিয়াব্যাপী চরম মুদ্রাস্ফীতির জন্য বাইডেনকেই দায়ী করেছেন। আর তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, আপনাদের সেই ভুল নীতির দায় আপনারা কেন আরবদের ওপর চাপাতে এসেছেন?
এক কথায় বললে, এই রিপোর্টের মূলকথা হলো, খুবই নরমভাবে কিন্তু কঠোর কূটনৈতিক ভাষায় তিনি বাইডেনের পলিসিকে বোকা জিদ্দি বলেছেন। বলেছেন, বাইডেনের চিন্তা-পলিসি অবাস্তব ফলে অকেজো! অর্থাৎ, আসলে একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের এটিও দেখতে বাকি ছিল!
সেকালে গ্লোবাল নেতা আমেরিকা আর সৌদি আরবের সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ৭৫ বছর আগে বাদশাহ আবদুল আজিজের সাথে সাক্ষাৎ দিয়ে। আর সেই সাক্ষাৎটা ঘটেছিল মিসরে। আজ যেমন মিসর সৌদিতে এসে দেখা করেছেন, সেকালে বাদশাহ আজিজ উজিয়ে মিসর গিয়ে রুজভেল্টের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন ১৯৪৫ সালে। সে বছরই রুজভেল্ট গ্লোবাল নেতা হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হন। আর আজ প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি সফর করে আমেরিকান মুকুট ধুলায় লুটিয়ে দিয়ে গেলেন। কারণ, এমবিএস বাইডেনকে কোনো কিছুরই প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
রয়টার্স তাই শেষে লিখছে, বাইডেনের ওই সফর শেষে ‘কোনো আশ্বাস বা সৌদি প্রতিশ্রুতির কোনো যৌথ ঘোষণা ছাড়াই শেষ’ হয়েছে। তাতে এমবিএসের যেটুকু বাস্তবতা জ্ঞান আছে এই বিচারে বয়োবৃদ্ধ বাইডেন হেরে গেছেন; জিদ্দি গোঁয়ার বয়স্ক মানুষ কেউ দেখতে পছন্দ করে না। বরং আশা করে, আমাদের মুরুব্বিরা অবশ্যই আমাদের চেয়ে ধৈর্যশীল স্থির এবং অভিজ্ঞতাব্ধতায় আমাদের ছাড়িয়ে যাবেন, সর্বোপরি আমাদের সবার চেয়ে বিবেচক হবেন। কিন্তু হায়! বাইডেন সবাইকেই হতাশ করেছেন! এ কারণে বেশির ভাগ মিডিয়ার এ নিয়ে রিপোর্টের শিরোনাম হলো : “আরব শীর্ষ সম্মেলনে তেল চুক্তিতে ব্যর্থ বাইডেন, ফিরলেন ‘শূন্য হাতে’।”
তাহলে কি আগামী নভেম্বরে আমেরিকান মিড টার্ম নির্বাচনে বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি শুধু গো-হারা হারবে? তাই নয়। আরো অনেক ব্যর্থতাও বাইডেনকে সম্ভবত আঁকড়ে ধরবে! ফলে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে আপস করার মুখে ফেলে বাইডেন পালিয়ে যাবেন? আর সব দিকের বিপদ টের পেয়ে সবার আগে ইইউ বাইডেনের হাত ছেড়ে এবারের শীতকাল শুরুর আগেই রাশিয়ার দিকে হাত বাড়াবেন? সবাইকেই বাস্তবতার সামনে মাথা নামাতে হয়, এই বাণী দিতে দিতে?
কেন এমন কথা বলছি?
গত ১৯ জুলাইয়ের খবর হলো ইইউ ইতোমধ্যেই ‘অধোমুখ’ মানে মাথা নিচু করে ফেলেছে। অর্থাৎ ‘রাশিয়ার সাতটি ব্যাংকের ওপর অবরোধের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ইইউ’- এই হলো সংবাদ শিরোনাম। এটিও রয়টার্সের খবর যে এক ‘ বৈঠকে রাশিয়ার সাতটি ব্যাংকের ফ্রিজ করা অর্থ ছাড় দেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন তারা। ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিটিবি, সোভকোম ব্যাংক, নোভিকোম ব্যাংক, অটক্রিটি ব্যাংক, প্রমসভায়াস ব্যাংক ও ব্যাংক রাশিয়া। তবে রুশ বৃহত্তম ব্যাংক সেবার ব্যাংকের সম্পদ ছাড়ের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন এক ইইউ কর্মকর্তা।
আবার আরেক হট নিউজ দিচ্ছে রয়টার্স। সৌদি আরব নিজের তেলের বিশাল রফতানিকারক হওয়া সত্ত্বেও উল্টা রাশিয়ান তেল আমদানি শুরু করেছে কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল। কেন?
কারণ, রাশিয়া সৌদি আরবকে ডিসকাউন্ট মূল্যে তেল দিচ্ছে বলে সৌদি আরব এই তেল আমদানি দ্বিগুণ করেছে যে তেল দিয়ে সে আসন্ন শীতে নিজের পাওয়ার স্টেশনের জ্বালানি চাহিদা মেটাবে। এতে তার নিজের বেঁচে যাওয়া জ্বালানি তেলও তাকে বাড়তি সুবিধা দেবে।
এসব খবর বাইডেনের দিক থেকে দেখলে তার জন্য আত্মহত্যামূলক বলতেই হয়! গত দুই বছরে তার নেয়া সব সিদ্ধান্ত, সব পলিসিই কি তাহলে মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে? ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে যাচ্ছে!
সর্বশেষ, আজকের খবর হলো, বাইডেন ইউক্রেনের ওপর কড়া শর্ত আরোপ করে রেখেছেন এই বলে যে, তারা যেন রাশিয়ার সাথে কোনো বিষয়ে আপসের কোনো আলাপই না করে। অথচ ইউক্রেন খাদ্য রফতানির দেশ হওয়া সত্তে¡ও যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়ান বাধায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য গুদামে আটকে আছে। গত এক মাস ধরে জাতিসঙ্ঘ আর তুরস্কের মধ্যস্থতায় এবং ফাইনালি এবার সেক্রেটারি জেনারেল গুতেরেস ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের উপস্থিতিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে যাতে আটকে থাকা খাদ্য বের হতে পারে। এটিও কি বাইডেনের জন্য ভালো লক্ষণ? সম্ভবত তার কপালই ভালো জানে!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply