চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় মাছুমা জান্নাত মহিলা মাদরাসায় সম্প্রতি ৯ বছরের এক ছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই একই মাদরাসার পরিচালকের বিরুদ্ধে ওই মাদরাসার ৩য় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগে স্থানীয়রা আলোচিত ওই মাদরাসা পরিচালক মুফতি গোলাম কিবরিয়াকে আটক করে পুলিশের হাতে দিয়েছে।
এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাদরাসা পরিচালক গোলাম কিবরিয়ার প্রকাশ্যে অপরাধের স্বীকারোক্তির ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দর্শনা থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। ভুক্তভোগী ছাত্রীকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছে পুলিশ।
এ ন্যাক্কারজনক ঘটনায় মাদরাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে দর্শনার বিভিন্ন মহল।
জানা গেছে, দর্শনা পৌর এলাকার হল্ট স্টেশন তেঁতুলতলায় ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মাসুমা জান্নাত মহিলা মাদরাসা। এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন বিতর্কিত ও আলোচিত মুফতি গোলাম কিবরিয়া, তার স্ত্রী, মেয়ে ও তার জামাই। অবাস্তব হলেও সত্য, মাদরাসা কমিটিও তাদের পরিবারের সদস্যরা, আবার শিক্ষক-শিক্ষিকাও ওই একই পরিবারের সদস্য।
গোলাম কিবরিয়া কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার মিরপুর থানার কুচিয়ামোড় গ্রামের মৃত নজির হোসেনের ছেলে। কিন্তু তারা ভাড়াবাড়িতে দর্শনায় বসবাস করেন এবং মাদরাসা পরিচালনা করছেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের নওদাগা হরিশপুরের কৃষক সাইফুল ইসলামের সাত বছরের মেয়েকে বছর তিনেক আগে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য দর্শনা মাছুমা জান্নাত মহিলা মাদরাসায় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। সম্প্রতি মাস খানেক ধরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর দিকে কুনজর পড়ে মাদরাসার পরিচালক গোলাম কিবরিয়ার।
পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগে বলা হয়, গোলাম কিবরিয়া ভয়-ভীতি দেখিয়ে স্টেশন সংলগ্ন ভাড়াবাড়িতে নিয়ে তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। কয়েকদিন আগে সহপাঠীদের কাছে ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস করলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এক পর্যায়ে সহপাঠীদের মাধ্যমে জানতে পারে ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রীর পরিবারের সদস্যরা। এ সময় গোলাম কিবরিয়া দর্শনার বাইরে থাকায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা ন্যায়বিচারের আশায় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে গেলেও কোনো সমাধান পাননি।
বৃহস্পতিবার গোলাম কিবরিয়ার ভাড়াবাড়িতে গিয়ে তাকে না পেয়ে মাদরাসায় গিয়ে বিষয়টি জানতে চাইলে শুরু হয় গোলাম কিবরিয়ার জামাতার সাথে বাগবিতণ্ডা। এক পর্যায়ে স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়ে মাদরাসা থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান গোলাম কিবরিয়া। এ সময় ধাওয়া করে মাদরাসা সংলগ্ন মাঠের ভেতর থেকে ধরা হয় অভিযুক্তকে। সাংবাদিক ও জনতার প্রশ্নের জবাবে অভিযুক্ত গোলাম কিবরিয়া ধর্ষণের কথা অকপটে শিকার করে বলেন, ‘শয়তানের ধোঁকায় পড়ে এ ভুল কাজ করেছি।’
এদিকে খবর পেয়ে দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এএইচএম লুৎফুল কবীর, পরিদর্শক (তদন্ত) আমানুল্লাহ আমান, থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই আহমেদ আলী বিশ্বাস ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। জনতার হাতে আটক ভণ্ড গোলাম কিবরিয়াকে নেয়া হয় পুলিশ হেফাজতে। দুপুরের মধ্যে মাদরাসার প্রায় ২ শ’ অভিভাবক তাদের মেয়েদের নিয়ে যান নিজের বাড়িতে। মাদরাসায় ঝুলিয়ে দেয়া হয় তালা।
এ ঘটনায় ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রীর বাবা গতকাল বৃহস্পতিবার গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে দর্শনা থানায় শিশু ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় দুপুর ২টার দিকে পুলিশ গ্রেফতার গোলাম কিবরিয়াকে আদালতে সোপর্দ করে। ধর্ষণের শিকার ওই শিশুকে গতকালই ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আহম্মেদ বিশ্বাস বলেন, মেয়ের বাবা মামলা করেছেন। ভিকটিম শিক্ষার্থীর ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়েছে এবং আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ধর্ষণের শিকার ছাত্রীর জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন। সেইসাথে পুলিশের পক্ষ থেকে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এএইচএম লুৎফুল কবীর বলেন, সকালে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীর বাবা মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। এরপরই আমরা অভিযান চালিয়ে মাদরাসার পরিচালক মুফতি গোলাম কিবরিয়াকে (৫৫) আটক করেছি। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে দর্শনা থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
উল্লেখ্য, এ মাদরাসায় গত ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর কুন্দিপুর গ্রামের দুলালের মেয়ে আফসানা খাতুন দোলা (৯) নামের এক ছাত্রী মারা যায়, যার মৃত্যুর প্রকৃত ঘটনা আজও উদ্ঘাটিত হয়নি।