১৯ বছর চাকরি করে একটা পয়াদন! গত ৩১ জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পিটিআই’র ৮২জন ইন্সট্রাক্টরকে সহকারী সুপার পদে পয়াদয় করে। ২০০৬, ২০০৭, ২০১২ সালে পিএসসি’র সুপারিশের মাধ্যমে ৯ম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত এসকল কর্মকর্তা। পিটিআই গুলোতে দীর্ঘদিন সহকারী সুপারের পদ শূন্য থাকলেও একটি পক্ষ অযৌক্তিক দাবী করে ফ্যাসিস্ট আমলের প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সহকারী সুপার পদে পদায়ন বাধাগ্রস্থ্য করার মাধ্যমে পিটিআই ইন্সট্রাক্টরদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল।
বর্তমান প্রশাসন বিষয়টির ন্যায্যতা অনুধাবন করে এসকল কর্মকর্তার পদায়ন দেওয়ায় পিটিআইগুলোতে আনন্দের আবেশ বয়ে চলছে।
উল্লেখ্য যে, পিটিআই ইন্সট্রাক্টর পদটি শুরু থেকেই রাজস্বখাতভূক্ত। নিয়োগবিধিমালা-১৯৮১ (সংশোধিত-১৯৮৯) মোতাবেক পিটিআই’র সহকারী সুপার পদে পিটিআই ইন্সট্রাক্টরদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ৮০% প্রমোশন দেওয়া হতো এবং বাকি ২০% সহকারী সুপার পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হতো। এ নিয়মই চলে আসছিল ২০২৩ সাল পর্যন্ত।
আবার বিপত্তিও ঘটে এই ২০২৩ সাল থেকেই! ১৯৯৮ সালে নোরাড প্রকল্পের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষার মান্নোয়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষন প্রদানের জন্য উপজেলা/থানা পর্যায়ে ‘উপজেলা/থানা রিসোর্স সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং প্রকল্পের আওতায় শর্ত সাপেক্ষে এ প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়।
এসকল রিসোর্স সেন্টারের অফিস প্রধানের পদটির নাম উপজেলা/থানা রিসোর্স সেন্টার ইন্সট্রাক্টর যা সংক্ষেপে ইউআরসি/টিআরসি ইন্সট্রাক্টর। এরপর প্রকল্পের আওতায় উক্ত প্রতিষ্ঠানে আরো কয়েক দফা একই শর্তে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে এসকল প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ২০০৫ সালে সকল উপজেলা/থানা রিসোর্স সেন্টারকে জনবলসহ নতুন শর্ত (SRO) সাপেক্ষে রাজস্ব ভুক্ত করা হয়। তাদের এই শর্তসমূহের মধ্যে একটি শর্ত এমন ছিল যে, তাদের চাকরি যেদিন নিয়োমিত করণের আদেশ জারি হবে সেদিন থেকে তারা সিনিয়রিটি পাবে।
তাদের চাকরি রাজস্ব খাত ভুক্ত হয় ২০০৫ সালে এবং তাদের চাকরি নিয়মিতকরণ আদেশ জারি হয় ২০১২ সালে। অর্থাৎ ২০১২ সাল থেকে তাদের সিনিয়রিটি গণ্য হবে। তাদের সিনিয়রিটির বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও নিয়োগবিধি বহির্ভূত থাকায় ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাদের প্রমোশন/পদায়নের কোনো সুযোগ ছিল না। ২০২৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা হলে সেখানে ১৯৮৯ নিয়োগ বিধিতে উল্লেখিত পিটিআই’র ইন্সট্রাক্টদের ৮০% পদোন্নতি বহাল রেখে সরাসরি নিয়োগের ২০% পদ ইউআরসি/টিআরসি ইন্সট্রাক্টরদের পদোন্নতি দেওয়ার বিধান রাখা হয়।
২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখে ২০০৫ সালের SRO মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে সিনিয়রিটি ধরে প্রণীত তাদের গ্রেডেশনের ভিত্তিতে, সহকারী সুপার পদায়নযোগ্য মোট পদের ২০% অর্থাৎ ২৭টি সহকারি সুপার ও ২টি গবেষণা কর্মকর্তা পদে মোট ২৯জন ইউআরসি/টিআরসি ইন্সট্রাক্টরকে পদায়ন প্রদান হয় (বর্তমানে তারা বিভিন্ন পিটিআইতে সহকারী সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন)।
এই পদায়নের কিছুদিন পরে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের আস্থাভাজন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব ফরিদ আহম্মেদ অজ্ঞাত কারণে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ইউআরসি/টিআরসি ইন্সট্রাক্টদের ২০১২ সালে নিয়মিতকরণ আদেশের তারিখ পরিবর্তন করে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের তারিখ থেকে সিনিয়রিটি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেন- যা 2005 সালে প্রকল্প থেকে রাজস্বে স্থানান্তর বিধি’র (SRO) সাথে সাংঘর্ষিক! পরবর্তীতে জনপ্রাশাসন মন্ত্রণালয় এই আদেশ যথাযথ নয় মর্মে মতামত দিয়ে পরিপত্র জারি করলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সাবেক সচিব জনাব ফরিদ আহম্মেদের বিতর্কিত প্রজ্ঞাপন বাতিল করে আদেশ জারির তারিখ অর্থাৎ ২০১২ সাল থেকে কার্যকারিতা দেখিয়ে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে।
ফলশ্রুতিতে ইউআরসি/টিআরসি ইন্সট্রাক্টরগণের সিনিয়রিটি ২০১২ সাল থেকে পুণঃবহাল হয়। পিটিআই ইন্সট্রাক্টর, ইউআরসি/টিআরসি ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা পাথমিক শিক্ষা অফিসার প্রাথমিক শিক্ষায় তিনটি সমমানের পদ হলেও এই তিনটি পদে নিয়োগ আদেশ যেমন ভিন্ন-ভিন্ন তেমনি গ্রেডেশনও ভিন্ন ভিন্ন। পদ তিনটির নিয়োগ যোগ্যতায়ও ভিন্নতা রয়েছে। পদায়নের ক্ষেত্রে এই তিনটি পদের একটি সাথে অন্যটির সিনিয়রিটি বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই; সুযোগ না থাকায় ২০২৪ সালে ইউআরসি/টিআরসির ২০১২ সালের ২৯জন ইন্সট্রাক্টরকে সহকারী সুপার পদে পদায়ন করা হলে ২০০৬, ২০০৭ সালে রাজস্বখাতে নিয়োগপ্রাপ্ত পিটিআই ইন্সট্রাক্টরগণ সিনিয়র হওয়া সত্তেও তাদের পদায়নে বাধা প্রদান করেননি।
কিন্তু ইউআরসির ২৯জন ইন্সট্রাক্টর সহকারী সুপার পদে পদায়ন পাওয়ার পর থেকেই পিটিআই ইন্সট্রাক্টরদের জন্য নির্ধারিত ৮০% পদে কর্তৃপক্ষ যাতে পদায়ন দিতে না পারেন এর জন্য বিভিন্ন অপচেষ্টা, মিথ্যাচার, মিথ্যা মামলা করে চলেছে। যায় মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিথ্যাচার এই যে, ‘তারা পিটিআই ইন্সট্রাক্টরদের চেয়ে সিনিয়র’! ২০১২সালে নিয়োমিতকরণকৃত ইন্সট্রাক্টর কীভাবে ২০০৬, ২০০৭ সালে রাজস্বখাতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সিনিয়র হয়?
তাদের এ সমস্ত কর্মকান্ডে পিটিআইসমূহে প্রশাসনিক পদ (সহকারী সুপার) অধিকাংশ শূন্য হয়ে পড়ায় পিটিআই’র স্বাভাবিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল দীর্ঘদিন। ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী প্রশাসন দীর্ঘ পর্যালোচনা ও তথ্য যাচাই-বাছাই করে নিয়োগবিধিমালা, ২০২৩ যথাযথভাবে অনুসরণপূর্বক ৮২ জন পিটিআই ইন্সট্রাক্টরকে একই গ্রেডে (৯ম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেডে) সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট পদে পদায়ন করেন। এর মাধ্যমে পিটিআইগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে, কর্মকর্তাদের মধ্যে জেগেছে কর্মস্পৃহা।
দীর্ঘদিন শূন্য থাকা সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট পদে পদায়নের ফলে পিটিআইসমূহে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো গতিশীল ও কার্যকর হবে হলে মনে করছেন প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল। এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল এবং পিটিআই কর্মকর্তা/কর্চারীগণ।