সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। তাদের গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে নির্দেশ দিয়ে আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
গতকাল চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের রাষ্ট্রপক্ষের পৃথক দুটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে গ্রেফতারি পরোয়ানা আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
তবে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি দেশে নেই, ভারতে অবস্থান করছেন। তা হলে তাকে কোন প্রক্রিয়ায় গ্রেফতার করা হবে। সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও আন্তর্জাতিক আইনে যেসব ব্যবস্থা আছে সেই সব প্রক্রিয়া এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করেই এ গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ দিকে ওবায়দুল কাদের ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার, প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক র্যা ব ডিজি হারুন অর রশিদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা তারেক আনাম সিদ্দিকী, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তবে তদন্তের স্বার্থে এবং তাদের গ্রেফতার নিশ্চিত করার স্বার্থে সবার নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে চিফ প্রসিকিউটর জানিয়েছেন।
আদালতের আদেশের পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আজ জুলাই-আগস্টে পরিচালিত ম্যাসাকার, হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করেছিলেন, তাদের প্রধান যিনি ছিলেন তিনি সাবেক প্রধান শেখ হাসিনা। তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আমরা আজ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদনে আমরা জুলাই-আগস্টে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, এসব কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা আমরা ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করেছি।
একই সাথে এই যে একটি সরকার কিভাবে দানবীয় সরকারে পরিণত হলো, কিভাবে নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্রদের গুলি করে মারল, তার প্রেক্ষাপটও এই আদালতের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম এই অপরাধগুলো এতো বিস্তৃত মাত্রায় সারা বাংলাদেশে সংগঠিত হয়েছে এবং এই অপরাধের আসামি যারা, তারা অসম্ভব রকমের প্রভাবশালী, তাদের গ্রেফতার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করাটা অসম্ভব রকম কঠিন। কারণ তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ, এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে সাহসী হচ্ছেন না।
সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমরা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানিয়েছি। ট্রাইব্যুনাল আবেদন মঞ্জুর করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। ১৮ নভেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে এই ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় আরেকটি আবেদনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হয়েছে। সেটিও মঞ্জুর করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
তাজুল ইসলাম বলেন, আপনারা জানেন এই অপরাধীরা এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছেন। সে কারণে তাদের নাম প্রকাশ করছি না। আমাদের তদন্তের স্বার্থে এবং তাদের গ্রেফতার নিশ্চিত করার স্বার্থে আমরা তাদের নাম প্রকাশ করছি না। তিনি বলেন, ১৮ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের ধার্য তারিখ। তবে গ্রেফতার করা মাত্রই আসামিদের ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে সবার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রথম আবেদনে শেখ হাসিনা এবং দ্বিতীয় আবেদনে ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সবার নাম এখানে উল্লেখ করা হয়নি। আমরা ধীরে ধীরে আরো তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে বাকিদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আজকে আমরা যাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি। তথ্যপ্রমাণ প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখার পর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন পড়েন। এ সময় সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর ভোটডাকাতি, মধ্যরাতের নির্বাচন থেকে গুম, খুন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান, অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান এবং সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনে বল প্রয়োগের তথ্য তুলে ধরেন তিনি।
এ ছাড়া কিভাবে বিচার বিভাগকে ধ্বংস, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রসঙ্গ, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের সময় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনা, র্যা ব কর্তৃক ডেথ স্কোয়াডে পরিণত হওয়া ও আয়নাঘরে গুম করে রাখার ঘটনা, দেশের অর্থ লুট করে কানাডায় বেগম পাড়া, রক্ষী বাহিনী ও বাকশালের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। কিভাবে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, কিভাবে সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে ভিন্নমত দমন করা হয়েছে তাও তুলে ধরেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনার সময় শেখ হাসিনা ছাত্রদের রাজাকার বলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় কিভাবে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালায় সে প্রসঙ্গ তুলে ধরে চিফ প্রসিকউটর বলেন, হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ও বোমাবর্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, কমপক্ষে ১৫০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলনের সময় শতাধিক শিশুও নিহত হয়েছে। অনেক শিশু ঘরের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। নিহত ছাত্রদের লাশে আগুন দেয়া হয়েছে, লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। অনেক লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়। এটি বিশে^র ইতিহাসে একটি ঘৃণ্য ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড।
চিফ প্রসিকউটর আরো উল্লেখ করেন, আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হন। তাদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেয়া হয়। অনেকে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। রাস্তায় রাস্তায় আহত রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সে বাধা দেয়া হয়। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়।
আসহাবুল ইয়ামিন হত্যাকাণ্ড : সাভারে এমআইএসটির শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনকে হত্যার ঘটনা ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনের নিথর দেহ টেনে নিচে ফেলার ঘটনা আদালতে বর্ণনা করেন তাজুল ইসলাম।
গাড়ি টান দেয়ার সময় চাকার নিচে পড়বে বলে দেহটি টেনে দূরে সরানো হয়। তখনও সেই দেহটি নড়তে দেখা যায়। এমন একটি লোমহর্ষক ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়। তাজুল ইসলাম বলেন, ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য রেখে কয়েকজন সাংবাদিকও উসকানি দেন। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলা হয়। ইস্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়ে গণহ্যার তথ্য আড়াল করা হয়, সঠিক তথ্য জানতে বাধা দেয়া হয়।
চিফ প্রসিকিউটর আদালতে বলেন, আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আসামি প্রভাবশালী। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে আসামির লোকজন বিভিন্ন পজিশনে আছে। আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার না করা হলে আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া মামলার তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করছি। এক পর্যায়ে আদালত জানতে চান, রাষ্ট্রীয়ভাবে আসামির অবস্থান জানেন কি না। জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, না।
এরপর আদালত আদেশ দেন। আদেশে আদালত বলেন, আমরা কনভিন্সড গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করার ব্যাপারে। এরপর আবেদন মঞ্জুর করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন আদালত। আর ১৮ নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির করতে বলেন।
উল্লেখ্য, গণহত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র্যা বের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে।
সূত্র. নয়াদিগন্ত