১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ পড়ে দেখেন, স্বাধীন বিচার বিভাগ সম্পর্কে কী বলা হয়েছে। সভ্যতার শুরুর দিকে শাসকই ছিলেন বিচারক। সভ্যতা গণতন্ত্রের দিকে পা বাড়াতে থাকলে বিচার বিভাগের ধারনা পাল্টে যেতে শুরু হয়। পৃথক বিচার ব্যবস্থার দাবী উঠে।
কারণ গণতন্ত্রে হারজিত থাকে। জয়ী হওয়া ব্যক্তি বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে পরাজিত ব্যক্তি জুডিসিয়াল কিলিং বা হেরাসম্যান্টের শিকার হতে পারেন। এই ধারনা থেকে দাবী উঠে পৃথক বিচার বিভাগের। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। আপনি সংবিধানের সব মানতে থাকলেন কিন্তু ২২ অনুচ্ছেদ মানতে বাধ্য করতে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করতে হল। তাও বিচার বিভাগের একজন বিচারক সরকারের বিরুদ্ধে ২২ অনুচ্ছেদ মানতে মামলা দায়ের করলেন। সেই আলোচিত মাসদার হোসেন মামলা।
সংবিধান রচনার ২৭ বছর পর ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগ ১২টি নির্দেশনা দিয়ে বিচার বিভাগ পৃথক করতে একটি রায় প্রদান করেন। আপিল বিভাগ একটি রায় দিলে রাষ্ট্র তাৎক্ষনিক পালন করতে বাধ্য কিন্তু ১৯৯৯ সালের রায় পালন করেনি বিএনপি জোট এবং আওয়ামীলীগ জোট সরকার। আপিল বিভাগের রায় দেয়ার পর কেটে যায় আরও ৮ বছর। সেনা শাসিত দীর্ঘমেয়াদী তত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট প্রতি বছর বিশ্বের কোন দেশে আইনের শাসন কেমন তা পর্যালোচনা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ছিল হতাশাজনক। আগে পিএসসির মাধ্যমে বিচারকদের নিয়োগ হতো। এখন জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন এর মাধ্যমে সহকারী জজ বা জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়োগ হয়। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছে। সরকারের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে আইন মন্ত্রনালয়কে তাদের ঘাড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ১৭ বছরেও বিচার বিভাগীয় সচিবালয় কার্যকর করা হয়নি। ফলে আইন মন্ত্রণালয় বড়বড় ছড়ি ঘুরাচ্ছে বিচার বিভাগের উপর। কার্যত নিম্ন আদালত চলে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনেই। যদিও সুপ্রিম কোর্টের নামমাত্র পরামর্শ নেয় তারা।
নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকুরীর শৃংখলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ করছে না সরকার। তাতে সরকারের কর্তৃত্ব কিছটা হৃাস পাবে বলে। নিম্ন আদালতের অর্থনৈতিক ব্যয় নির্বাহ করে আইন মন্ত্রণালয়। উচ্চ আদালতকে বলা হয় স্বাধীন। এমন ধারনা পাল্টে দিয়েছেন বিচারকরাই। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের মতো ব্যক্তিকে দলীয় ক্যাডার হিসাবে দেখা গেছে বিচারকের চেয়ারে। সরকারের পক্ষে দলীয় নেতার ভূমিকায় বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে অনেক বিচারককে। যার ফলে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ অনেক বিচারককে পদত্যাগ করতে হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি কিংবা অন্যান্য বিচারপতিদের পদত্যাগ বিচার বিভাগের বা একটি দেশের জন্য কোনো সুখখর খবর নয়। উচ্চ আদালতের বিচারকেদর চেয়ার এতোটাই শক্তিশালী যে, কারো দাবীতে তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য নন। সংবিধানের ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতিত কোনো বিচারককে অপসারণ করা যায় না। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের তদন্ত করারও বিধান রয়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারনের কিছু নিয়ম থাকলেও বিচারক নিয়োগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনই নেই।
দলীয় দৃষ্টিকোন থেকেই সব সরকার উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকে। ফলে দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিচারকদের অনেকেই বের হতে পারেননি। ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের দিক নির্দেশনা চেয়ে একটি মামলা হয়। মামলায় আইন সচিব, মন্ত্রি পরিষদ সচিব, প্রধান মন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্ট্রার জেনারেলকে বিবাদী করা হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে তারা মামলায় কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি, এমনকি পক্ষই হননি। আদালতকে সহযোগিতা না করায় তাদের সমালোচনা করা হয় মাত্র কিন্তু তাদেরকে বাধ্য করা যায়নি। যদিও ২০২৪ সালের ১৩ এপ্রিল উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের কিছু পর্যবেক্ষন দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়। ১৯৭১ সালে অনেক বিচারক বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন, অনেক বিচারক নিরপেক্ষ ছিলেন, অনেক বিচারক পাকিস্তান সরকারের তল্পীবাহক ছিলেন।
পরবর্তীতে কাউকে কিন্তু পদত্যাগ করতে হয়নি, কাউকে অপসারণও করা হয়নি। ১৯৭৫,১৯৯০,২০০৬,২০০৭,২০০৮ সালের দিকে থাকান। অনেক বিচারক ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে শোর মেলাননি। তাদেরকেও পরবর্তীতে পদত্যাগ করতে হয়নি। ২০২৪ সালে এসে এমন ব্যতিক্রম দৃশ্য কেন আমাদেরকে দেখতে হলো।
বিচারকদের এতোটা দলীয় হওয়া প্রয়োজন ছিল কি না তা নিয়ে গবেষনা হতে পারে। আইনের একজন নগন্য ছাত্র হিসাবে আমি মনে করি বিচার বিভাগ সম্পুর্ণভাবে নিরপেক্ষ থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বিচারকরা যখন তাদের বিচারকের আসনে বসেন তখন সূরা আত্ব-ত্বীনের একটি আয়াতের দিকে লক্ষ্য রাখলেই যথেষ্ট হতে পারে। আর তা হচ্ছে বিচারকদের উপরে সর্বশ্রেষ্ট বিচারক হচ্ছেন মহান আল্লাহ। এর মধ্যে বিচারকাজে আর কাউকে কর্তা না মানলেই হয়। সদ্য ঘোষিত “ ইয়াং জাজেস ফর জুডিসিয়াল রিফর্ম” একটা সময় আরেকটি দলীয় সংগঠনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।
এম এ মজিদ
আইনজীবী ও সংবাদকর্মী
হবিগঞ্জ ১০ আগষ্ট ২০২৪
০১৭১১-৭৮২২৩২