নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি নিয়ে আন্দোলনে থাকা বিরোধী দলগুলো মূলত এখন ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে। হরতাল-অবরোধ ছাড়াও সমাবেশ ধরনের নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এমন একপর্যায়ে নির্বাচনী প্রচারণা ব্যতীত সভা-সমাবেশসহ সবধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজনের অনুমতি না দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিরোধী দলগুলো বলছে, ইসির এই চিঠি আমলে নেয়ার কিছু নেই। কারণ রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে সরকার একটা একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এই একতরফা, ডামি নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার অধিকার জনগণের রয়েছে।
জানা গেছে, এক দফা দাবিতে বিএনপি ও শরিকরা চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখবে। আগামী সপ্তাহে আবারো অবরোধ দেয়ার আলোচনা হয়েছে। এর পাশাপাশি পেশাজীবীদের ব্যানারে কয়েকটি সমাবেশ করার চিন্তা করা হচ্ছে। বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে বড় র্যালি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, নির্বাচন নির্বিঘ্নে করতে ইসির এই চিঠির পর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরো কঠোর হতে পারে। এর ফলে বিএনপি হরতাল-অবরোধের বাইরে মাঠে নেতাকর্মীদের জমায়েতের কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারবে কি না, এটা নিয়ে তারা সন্দিহান।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অবশ্য গতকাল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের এই ধরনের নির্দেশনায় চলমান আন্দোলন দমানো যাবে না। তিনি বলেন, ‘ইসির এই চিঠির উদ্দেশ্য একটাই- বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা, বিরোধী দলের আন্দোলন দমানোর অপেচষ্টা করা। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে আর তার বশংবদ নির্বাচন কমিশন তাতে শেষ পেরেক ঠুকতে চাচ্ছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এসব নির্দেশনা জারি করে কোনো লাভ হবে না, কোনো পরিপত্র জারি করে জনগণের আন্দোলন দমানো যাবে না। এবার জনগণ বিজয় নিশ্চিত করেই ঘরে ফিরবে।’
আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণা ব্যতীত সভা-সমাবেশসহ সবধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজনের অনুমতি না দিতে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী কাজ বাধাগ্রস্ত ও ভোটাররা ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত হতে পারে- এমন আশঙ্কায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চিঠিতে ইসি বলেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি ধার্য রয়েছে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা শুরু হবে। ১৮ ডিসেম্বর থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ব্যতীত নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে বা ভোটাররা ভোটদানে নিরুৎসাহিত হতে পারে এরূপ কোনো প্রকার সভা, সমাবেশ বা অন্য কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা থেকে সবাইকে বিরত রাখা বাঞ্ছনীয়।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর। ১৯ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রচার চালাতে পারবেন প্রার্থীরা। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। অন্য দিকে বিএনপি, সিপিবি, জেএসডি, ইসলামী আন্দোলনসহ বহু রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দলগুলো বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিয়ে আসছে। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হলেও দলটি বিএনপির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
জানা গেছে, বিরোধী দল এসব কর্মসূচি নির্বাচন আয়োজন এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে বাধা হিসেবে দেখছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য নির্বাচন ঠেকাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন যাতে সভা-সমাবেশ করতে না পারে, সরকারকে সেই পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলো ইসি।
ইসির চিঠি প্রসঙ্গে বিএনপি ও যুগপতের শরিক একাধিক নেতা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে বহুবার রাজনৈতিক দলগুলো ভোট বর্জন করেছে। এরশাদের আমলে, ’৯৬ সালে, ২০১৪ সালে এমনটা হয়েছে। কিন্তু তখন এমন কোনোকিছু হয়নি। কেবল সংবিধান স্থগিত থাকলে তখন এ ধরনের সামরিক ফরমান জারি হতে পারে। সুতরাং এমন চিঠি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত, সাংবিধানিক বিধানের পুরোপুরি পরিপন্থী। ভোটে অংশ নেয়া, ভোটের পক্ষে ক্যাম্পেইন করা যেমন নাগরিকের অধিকার; তেমনি একতরফা নির্বাচন, জালিয়াতির ভোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার অধিকারও জনগণের রয়েছে। নাগরিকদের এই অধিকার হরণ করার কোনো এখতিয়ার-অধিকার নির্বাচন কমিশনের নেই। ফলে কোনো বিরোধী দলের এটাকে (চিঠি) আমলে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনের উচিত, অবিলম্বে এই চিঠি প্রত্যাহার করা।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, একতরফা-পাতানো নির্বাচনের বিপক্ষে জনমতকে সংগঠিত করার জন্য আন্দোলনের সব গণতান্ত্রিক ফর্ম আমরা অনুসরণ করব। এ ক্ষেত্রে আগামীতে হরতাল-অবরোধের সাথে সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি আমাদের বিবেচনায় আছে। এসব কর্মসূচি পালনের সম্পূর্ণ সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রয়েছে। নির্বাচন কমিশন কোনো প্রজ্ঞাপন বা চিঠি দিয়ে রাজনৈতিক দল ও জনগণের এই সাংবিধানিক অধিকার হরণ করতে পারে না। নির্বাচন কমিশনের এই ধরনের তৎপরতা ঔদ্ধত্যের শামিল।
জানা গেছে, বিএনপি ও যুগপতে থাকা মিত্রদের লক্ষ্য এখন ভোট ঠেকানো। এ জন্য ভোটের প্রচার শুরুর দিন থেকে ৭ জানুয়ারির মধ্যবর্তী সময়কে আন্দোলনের ‘মোক্ষম সময়’ হিসেবে বিবেচনা করছে তারা। এ সময়ে হরতাল-অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে বিএনপিপন্থী পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ, বিক্ষোভ সমাবেশের মতো কর্মসূচি চালু থাকবে। এ ছাড়া নেতাকর্মীদের আত্মগোপন অবস্থা থেকে বাইরে নিয়ে আসতে দলীয় ব্যানারেও জমায়েতের কর্মসূচি দিতে পারে। এর অংশ হিসেবে আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে উপলক্ষ করে ঢাকায় বড় জমায়েত করতে চায় বিএনপি। ওই দিন রাজধানীতে বিজয় শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
এই শোভাযাত্রাকে ‘একতরফা’ নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শোভাযাত্রায় পরিণত করতে চায় বিএনপি। ওই দিন বেলা ১টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে মগবাজার পর্যন্ত এই শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতা চেয়ে গতকাল বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বরাবর চিঠি দিয়েছে দলটি। এ ছাড়া বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতার কবরে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এ দিকে আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করবে বিএনপি।
দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা জানান, বড় জমায়েত করার জন্য জাতীয় দিবসের কর্মসূচিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চান তারা। চলতি মাসজুড়ে এভাবে আন্দোলন এগিয়ে নিতে চায় বিএনপি। এই সময়ের মধ্যে ঢাকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাওয়ের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে বিএনপি ও যুগপতে থাকা মিত্রদের। আর জানুয়ারির শুরু থেকে শক্তভাবে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। ওই সময়ে দীর্ঘ দিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করারও চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি।