দেশে নির্বাচনের কোনো ‘পরিবেশ না থাকায়’ এখনি তফসিল ঘোষণার পক্ষে নয় বিএনপিসহ রাজপথে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, একতরফা তফসিল ঘোষণা করা হলে লাগাতার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে যাবে তারা। কোনো সমঝোতা কিংবা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি থেকে তারা পিছু হটবে না।
এ দিকে সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে তিন দফা টানা অবরোধের পর দেশব্যাপী আবারো ৪৮ ঘণ্টার ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ কর্মসূচি শুরু হয়েছে আজ। আজ রোববার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত চতুর্থ ধাপের এই অবরোধ কর্মসূচি চলবে। যুগপৎভাবে এই কর্মসূচি পালিত হবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, জনদাবি ও দেশী-বিদেশী নানা পক্ষের সব মত উপেক্ষা করে তফসিল দেয়া হলে তারা লাগাতার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে যাবে। মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা তথা জনস্বার্থে শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। অবশ্য শুক্র ও শনিবার বিক্ষোভের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-অবরোধের সাথে অসহযোগ আন্দোলনেও যেতে পারে বিএনপি ও শরিকরা। অসহযোগের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিলেও বিষয়টি ভাবনায় রয়েছে তাদের।
সূত্র মতে, জনস্বার্থে এখন পর্যন্ত শুক্র ও শনিবার ছাড়াও সপ্তাহে আরো এক দিন কর্মসূচির আওতামুক্ত রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপি ও শরিকদের। এ পর্যন্ত পালিত হওয়া তিন ধাপের অবরোধ কর্মসূচিতে সেটা অনুসরণও করা হয়েছে। রবি ও সোমবার এবং বুধ ও বৃহস্পতিবার কর্মসূচি হলেও মাঝে মঙ্গলবার বিরতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তফসিলের পরে রবি থেকে বৃহস্পতিবার টানা হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি চলতে পারে।
এ দিকে চতুর্থ ধাপের অবরোধ কর্মসূচি শেষে চলতি সপ্তাহের শেষ দু’দিন হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে বলে বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা জানিয়েছেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, এ মুহূর্তে সরকার একতরফা তফসিল ঘোষণা করলে তারা পুনরায় এটাই প্রমাণ করবে যে, আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী নয়, বরঞ্চ একদলীয় স্টিম রোলার চালিয়ে দেশ শাসন করতে চায়। তিনি বলেন, সরকারি দল হয়তো মনে করছে অতীতের মতো একটি একতরফা সাজানো নাটক করে এবারো নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে। তবে বিষয়টি হচ্ছে এই যে- এখন আর ২০১৪ বা ২০১৮ সাল নয়, ২০২৪-এ এসে এখন সরকার আর দেশে-বিদেশে কাউকে বোকা বানাতে পারছে না। কারণ তাদের ‘অলটারনেট গণতন্ত্রের’ ফানুস ইতোমধ্যেই ফেটে ভেতরের গ্যাস বের হয়ে চুপসে গেছে।
মঈন খান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বর্তমান সরকার নতুন করে আবার একদলীয় সবকার গঠন করে দেশের মানুষের ভোটাধিকারসহ সব অধিকার হরণ করেই চলবে, এটা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ আর হতে দেবে না।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ-সমাবেশের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামে বিএনপি ও শরিকরা। পুলিশ হামলা চালিয়ে মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেয়ার প্রতিবাদে পরদিন সারা দেশে হরতালের কর্মসূচি পালন করে তারা। এরপর বিএনপির মহাসমাবেশে হামলা, নেতাকর্মীদের হত্যা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আন্দোলনরত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি-হয়রানি ও
নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে একদিন বিরতি দিয়ে প্রথম দফায় ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা, ৫-৬ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টা এবং তৃতীয় দফায় ৮-৯ নভেম্বর ৪৮ ঘণ্টার রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ মিত্ররা। অর্থাৎ গত দুই সপ্তাহে তিন দফায় ১৬৮ ঘণ্টার অবরোধ এবং ২৪ ঘণ্টা হরতালের কর্মসূচি পালন করেছে তারা। এ দিকে আগামী ১৪ নভেম্বর কিংবা এর কাছাকাছি সময়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
দেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নেই দাবি করে গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিএনপির শরিকরা ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) একতরফা তফসিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়েছে। বিএনপির দাবি, বর্তমান সঙ্ঘাত-সংঘর্ষময় পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট বাদে কোনো রাজনৈতিক দলই একতরফা তফসিল চায় না। দলটির নেতারা বলছেন, দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারাগারে। দলীয় নির্দেশনায় বাকি নেতারা গ্রেফতার এড়িয়ে চলছেন। তালাবদ্ধ দলীয় কার্যালয় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচনে অযোগ্য করতে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাজা দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচনের কোনো পরিবেশ রাখা হয়নি। এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণা হবে আত্মঘাতী। এর মধ্য দিয়ে সরকার যে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, সেটিই প্রমাণিত হচ্ছে।
নেতাদের মতে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন যেমন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, তেমনি আবার একটি একতরফা নির্বাচন হলে সেটিও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, বরং সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। কারণ, আগামীতে অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর পশ্চিমা বিশে^র চাপ অব্যাহত রয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে থাকা বিএনপি দাবি আদায় করেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার অনড় অবস্থানে রয়েছে দলটি। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির চলমান আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফলতা না পেলে তাদের সামনে দু’টি বিকল্প থাকবে। এক. দশম সংসদের মতো আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জনের পথে হাঁটা এবং দুই. সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে যাওয়া। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ইস্যুতে ক্ষমতাসীনদের সাথে কোনো সমঝোতায় যাবে না বলেও ইতোমধ্যে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা এবং যুগপতের শরিকদের জানিয়ে দিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড।
যুগপতের শরিকদের সাথে বৈঠকগুলোতে তাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার অনুরোধও জানানো হয়েছে। একই সাথে নির্বাচনে গেলে তারা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হবেন বলেও সতর্ক করেছে বিএনপি। শরিকরাও বিএনপিকে ছেড়ে নির্বাচনে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিএনপির প্রত্যাশা, তারা নির্বাচন বর্জন করলে যুগপতের শরিকরা ছাড়াও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা অন্য দল ও জোটও নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেবে।
অনির্দিষ্টকালের হরতাল-অবরোধ : গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সিইসিকে একতরফা তফসিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়েছি। কারণ, দেশে এখন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই, কোনো গণতান্ত্রিক অবস্থা নেই। তাছাড়া সংবিধান অনুযায়ী জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় আছে, তাই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করলেও কোনো সমস্যা নেই।
তাই ইসি এই মুহূর্তে তফসিল ঘোষণা না করে নৈতিক জায়গা থেকে সরকারকে বলতে পারেন, আপনারা বিএনপিসহ সব দলের সাথে বসে নির্বাচকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসন করুন। অন্যথায় আমাদের পক্ষে একতরফা নির্বাচনের ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়। তারপরও তারা যদি জোর-জবরদস্তি করে একতরফা তফসিল ঘোষণা করেন, জনগণ ও বিরোধী দল সাজানো একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণ তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ জোরদার করবে।